Friday, December 18

সালাম, মুসাফা ও মুয়ানাকা


ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা: সালাম : মুসলমানের পরস্পরের মধ্যে অভিবাদন জানানো এবং পারস্পরিক সৌহার্দ, সম্প্রীতি, নিরাপত্তা ও ভালোবাসা প্রকাশের অতুলনীয় মাধ্যম হলো সালাম। সেই সঙ্গে সালাম ইসলামী সমাজের অন্যতম প্রতীক এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ্ তায়ালা আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার পরপরই তার প্রতি ফেরেশতাদের অভিবাদন জানানোর জন্য সালাম দেয়ার নির্দেশ দেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন আল্লাহ তায়ালা তাকে সৃষ্টি করলেন তখন বললেন, যাও অমুক স্থানে ফেরেশতাদের একটি দল রয়েছে তাদের সালাম করো। আর তুমি তাদের জবাব শোন। কারণ সেটিই তোমার এবং তোমার সন্তানদের অভিবাদন। আদম (আ.) গিয়ে ফেরেশতাদের উদ্দেশে আসসালামু আলাইকুম বলে সালাম দিলেন। ফেরেশতারা জবাবে বললেন, আসসালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহ। তারা ওয়া রাহমাতুল্লাহ বেশি বললেন। (বোখারি)। জান্নাতে প্রবেশকালে আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিবাদন হবে সালাম। (সূরা আহজাব : ৪৪)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে যেতে পারবে না। আর তোমরা পরস্পরে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার বিষয়টি বলে দেব? তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রচলন করো। (মুসলিম)। সালামের জবাব : স্পষ্ট ভাষায় আসসালামু আলাইকুম বলে সালাম দিতে হয়। জবাবে একটু বাড়িয়ে ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলে উত্তর দিতে হয়। সালাম দেয়ার ক্ষেত্রে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বললে জবাবে ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুল্লাহ বলতে হয়। আর সালাম দেয়ার ক্ষেত্রে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুল্লাহ বললে জবাবেও অনুরূপ ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুল্লাহ বলতে হয়। এর চেয়ে অতিরিক্ত আর কিছু নয়। সালাম প্রদান ও জবাব দেয়ার ব্যাপারে এমন বিধানের প্রতি আল্লাহ তায়ালা নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, 'তোমাদের যখন অভিবাদন করা হয় তখন তোমরাও তা অপেক্ষা উত্তম প্রত্যাভিবাদন করবে অথবা তার অনুরূপ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী।' (সূরা নিসা : ৮৬)। মুসাফা বা করমর্দন : মুসাফা বা করমর্দন হলো সালামের পরিপূরক। হজরত আবদুুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেন, 'সালামের পরিপূর্ণতা হলো মুসাফা।' (তিরমিজি)। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) এর অভ্যাস ছিল, কোনো ব্যক্তি এগিয়ে এলে মুসাফা করতেন। সে ব্যক্তি হাত না সরানো পর্যন্ত তিনি নিজের হাত সরাতেন না এবং চেহারা না ফেরানো পর্যন্ত তিনি মুখ ফেরাতেন না। সঙ্গে উপবিষ্ট লোকদের সামনে হাঁটুদ্বয় ছড়িয়ে বসতেন না। (তিরমিজি)। হজরত বারা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, দুইজন মুসলমান পরস্পর সাক্ষাতের পর মুসাফা করলে তাদের পৃথক হওয়ার আগেই তাদের পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ)। মুসাফার পদ্ধতি : সালাম বিনিময়ের পর উভয়ে উভয়ের দু'হাতের মাধ্যমে মুসাফা করা সুন্নত। প্রথমত এ বিষয়ে ইমাম বোখারি (রহ.) বোখারির মুসাফা অধ্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, উভয় হাত দ্বারা মুসাফা করার বর্ণনা। হজরত হাম্মাদ ইবনে জায়েদ (রহ.) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) এর সঙ্গে উভয় হাত দ্বারা মুসাফা করেছেন। (বোখারি)। দ্বিতীয়ত. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.) আমাকে 'আততাহিয়্যাত' এমনভাবে মুখস্থ করিয়েছেন যে, আমার হাত তাঁর উভয় হাতের মধ্যে ছিল। (বোখারি)। এতেও প্রমাণিত হয় যে, রাসুল (সা.) এর যুগে উভয় হাত দ্বারা মুসাফা করারই প্রচলন ছিল। তৃতীয়ত. কোনো হাদিসে সরাসরি একথা আসেনি যে, রাসুল (সা.) একহাতে মুসাফা করেছেন। বরং কিছু হাদিসে উভয় হাত দ্বারা মুসাফা করার প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর বর্ণনায় দেখা গেল। আর কিছু হাদিসে শুধু হাত দ্বারা মুসাফা করার কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন- আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর অন্য বর্ণনায় আছে, সালামের পরিপূর্ণতা হলো হাত ধরা। (তিরমিজি)। চতুর্থত. বিভিন্ন হাদিস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হাত বললে দুই হাতই বোঝায়। যেমন- রাসুল (সা.) বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, 'প্রকৃত মুসলমান সে ব্যক্তি যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে সব মুসলমান নিরাপদ থাকে।' (বোখারি, মুসলিম)। এখানে হাত বললেও অবশ্যই দুই হাত উদ্দেশ্য। আবু সাঈদ (রা.) বলেন, 'আমি রাসুল (সা.) কে বলেতে শুনেছি, যে কোনো অন্যায় হতে দেখলে সে যেন হাত দ্বারা তা প্রতিহত করে। যদি সম্ভব না হয় তাহলে যেন মুখ দ্বারা তা প্রতিহত করে। যদি সম্ভব না হয় তাহলে যেন অন্তর দ্বারা ঘৃণা করে আর এটিই নিম্নস্তরের ঈমান।' (মুসলিম, তিরমিজি)। এখানেও অবশ্যই দুই হাত উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে কোনো এক হাত বোঝাতে চাইলে নির্দিষ্ট করে ডান বা বাঁ হাত উল্লেখ করা হয়। যেমন- খাদ্য গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ডান হাত দ্বারা খেতে বলা হয়েছে। হজরত উমার ইবনে আবি সালামা (রা.) বলেন, নবী (সা.) আমাকে বলেছেন, 'তুমি তোমার ডান হাতে খাও।' (বোখারি, মুসলিম)। হজরত উমার ইবনে আবি সালামা (রা.) বলেন, নবী সা. আমাকে বলেছেন, 'তুমি তোমার ডান হাতে খাও।' (বোখারি, মুসলিম)। বাঁ হাতে খেতে নিষেধ করা হয়েছে। হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) বলেছেন, 'তুমি তোমার বাঁ হাতে খেয়ো না।' (মুসলিম)। ডান হাতে ইস্তেনজা করতে নিষেধ করা হয়েছে। হজরত আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, 'যখন কেউ টয়লেটে আসে সে যেন তার ডান হাত দ্বারা লজ্জাস্থান না ধরে এবং যেন তার ডান হাত দ্বারা না করে।' (বোখারি, মুসলিম)। পঞ্চমত. এক হাতে মুসাফা করা বর্তমানে একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, যা মূলত পশ্চিমারা সর্বপ্রথম চালু করেছে। অথচ মুসাফা একটি ইবাদত যা স্বীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যে সমৃদ্ধ। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন, 'যে কোনো জাতির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে।' (আবু দাউদ)। মুয়ানাকা বা কোলাকুলি : দীর্ঘদিন পর একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে পরস্পরে মুয়ানাকা বা কোলাকুলি করা সুন্নত। কেউ সফর থেকে এলে দীর্ঘদিন পর দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ায় সাহাবায়ে কেরাম মুয়ানাকা বা কোলাকুলি করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, 'জায়েদ ইবনে হারিসা (রা.) যখন মদিনায় এলেন তখন নবী (সা.) আমার ঘরে ছিলেন। জায়েদ (রা.) তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আমার ঘরে এলেন এবং দরজায় টোকা দিলেন। রাসুল (সা.) নিজের কাপড় সামলাতে সামলাতে উঠে গেলেন এবং জায়েদের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন এবং তাকে আদর করলেন।' (তিরমিজি)। সাহাবায়ে কেরাম পরস্পরে মুসাফা করতেন আর কেউ সফর থেকে এলে তার সঙ্গে কোলাকুলি করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা)। মুয়ানাকা বা কোলাকুলির পদ্ধতি : মুয়ানাকা বা কোলাকুলি হলো দুই ব্যক্তির প্রত্যেকে নিজ নিজ থুতনি অন্যের কাঁধের ওপর রাখা এবং গলা অন্যের গলার ওপর রাখা এবং উভয় হাত দ্বারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা। (মুহাম্মদ কালজায়ি, মুজামু লুগাতিল ফুকাহা : ৪৩৮)। কাজেই এভাবে মুয়ানাকা বা কোলাকুলি করা উচিত। আর তা শুধু একবারই যথেষ্ট। তিনবারের প্রয়োজন নেই। ঈদের নামাজের পর সালাম, মুসাফা ও মুয়ানাকা : মুসলমানদের পরস্পরে সালাম বিনিময় হলো একটি ইবাদত এবং পরস্পরিক অভিবাদন, সৌহার্দ-সম্প্রীতি ও ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম। মুসাফা বা করমর্দন হলো সালামের পরিপূরক। আর দীর্ঘদিন পর একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে পরস্পরে মুয়ানাকা বা কোলাকুলি করা হলো আন্তরিকতার বহির্প্রকাশ। কাজেই সালাম, মুসাফা ও মুয়ানাকা সর্বদা সব স্থানে মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে চলমান একটি বিষয়। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়