Friday, December 25

পবিত্র মিলাদুন্নবী ও সিরাতুন্নবী (সা.)


মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বিশ্বের বিস্ময়, নবী ও রাসুলদের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ, বিশ্বনবী আহমাদ মুজতবা মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যাঁর গুণকীর্তনে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান এমনকি নাস্তিকরা পর্যন্ত পঞ্চমুখ; কাফের, মোশরেক- জানের দুশমনরাও যাঁকে 'আল আমিন' তথা মহাসত্যবাদী বা পরম বিশ্বাসী আখ্যায় আখ্যায়িত করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি; যাঁর আবির্ভাবে কিসরা ও কাইজারের গগনচুম্বী রাজপ্রাসাদ ভূমিতে লুটে পড়ে; পারস্যের অনির্বাণ অগ্নিকুন্ড চির নির্বাপিত হয়; দেবালয়ের প্রস্তর মূর্তি মর্তে কপাল ঠুকে; তাঁর সে শুভাগমনকে বিশ্ব বিবেক ক্ষণিকের তরেও ভুলতে পারে না। বর্ষের ৩৬৫টি দিবসই যদি তাঁর পবিত্র মহামিলাদ বা জন্ম স্মরণ করা হয় তথাপিও রোজ কেয়ামত পর্যন্ত এর প্রয়োজন ও গুরুত্ব বিন্দুমাত্র হ্রাস পাবে না। তাই তো দুনিয়া প্রতি মুহূর্তে গাইছে: 'সল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা।' বালাগাল উলা বি কামালিহি, কাশাফাদ দুজা বি জামালিহি; হাসুনাত জামিউ খিসালিহি, সল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি। 'সবার ওপরে আসন যাঁর; তাঁর রূপের ঝলকে কেটেছে অাঁধার, সব কিছুই সুন্দর তাঁর; দরুদ তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে।' মহানবী (সা.) এর আবির্ভাব দিবসটি আমাদের সমাজে ফাতেহায়ে দোয়াজদাহুম নামে পরিচিত। 'ফাতেহায়ে দোয়াজদাহুম' কথাটি ফারসি ভাষা থেকে আগত। দোয়াজদাহুম মানে ১২, ফাতেহায়ে দোয়াজদাহুম অর্থ হলো, ১২ তারিখের ফাতিহা অনুষ্ঠান। কালক্রমে এ দিনটি মিলাদুন্নবী (সা.) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এর অর্থ হলো, নবী করিম (সা.) এর জন্ম অনুষ্ঠান। ধীরে ধীরে এর সঙ্গে 'ঈদ' শব্দ যোগ হয়ে 'ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)' রূপ লাভ করে। যার অর্থ হলো, মহানবী (সা.) এর জন্মোৎসব। এ পর্যায়ে আরেকটি পরিভাষাও প্রচলিত হতে থাকে 'সিরাতুন্নবী (সা.)' অর্থাৎ নবী করিম (সা.) এর জীবনচরিত বা জীবনী আলোচনা অনুষ্ঠান। এ দিবসে অনেকে জশনে জুলুস বা শোভাযাত্রা ও আনন্দ র‌্যালি করে থাকেন। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, সেদিন ছিল ৫৭১ খিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল। আর তিনি ইহধাম থেকে চিরবিদায় নেন রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ দ্বিতীয় সোমবার অপরাহ্নে বা গোধূলিলগ্নে। বসন্তের সুরভী ও অমীয় বারতা নিয়ে ধরাধামে শুভাগমন করেন। তাঁর বেলাদাত ও ওফাত ১২ রবিউল আউয়াল প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। প্রিয়নবী (সা.) এর আগমন ও প্রস্থান একই দিনে একই সময়ে এ কথাও প্রসিদ্ধ। কথায় আছে- সৃষ্টির জন্য যাঁদের সৃষ্টি, তাঁরা চির অমর। আসল কথা হলো, তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা; কোরআন ও সুন্নাহ অাঁকড়ে ধরা; একমাত্র ইসলামকেই ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির অনন্য পথ হিসেবে গ্রহণ করা। পরিতাপের বিষয় হলো, রবিউল আউয়াল মাস এলে আমরা আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করি। বাণী আর বিবৃতি প্রচার করি; কিন্তু ফরজ-ওয়াজিব আদায় করি না, হারাম সুদ পরিত্যাগ করতে পারি না, দুর্নীতি ও ঘুষ ছাড়তে পারি না, মিথ্যা বর্জন করতে পারি না, লোভ হিংসা মোহমুক্ত হতে পারি না। এমন হয় কেন? তবে কি নবীপ্রেমের তাৎপর্য আমাদের অন্তরে স্থান পেয়েছে? মনুষ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর পরিচয় লাভ করা। নবী রাসুল প্রেরণের লক্ষ্য হলো, মানুষকে আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। তাই আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসুল (সা.) এর পথ অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ রাসুল (সা.) যা যা করেছেন বা করতে বলেছেন, তা করতে হবে। আর যা করেননি বা করতে বারণ করেছেন তা বর্জন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের ঘোষণা, 'যা দিয়েছেন তোমাদের রাসুল (সা.) সুতরাং তা ধারণ করো; আর যা থেকে বারণ করেছেন, তা থেকে বিরত থাক।' (সূরা হাশর : ৭)। আল কোরআনে আরো বলা হয়েছে, 'বলুন [হে রাসুল (সা.!)] যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসবে, তবে আমার অনুকরণ করো; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।' (সূরা বাকারা : ৩১)। হাদিসে আছে, 'তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মোমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি হবো তার কাছে তার বাবা-ছেলে ও সব মানুষ (এবং যাবতীয় সবকিছু) থেকে প্রিয়।' এ আলোকে নিশ্চিত করে বলা যায়, রাসুল (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা ঈমানের পূর্বশর্ত। আর এ ভালোবাসা তাঁর নির্দেশ পালন ও অনুকরণের মাঝেই প্রকাশ পাবে। আমরা যখন উৎসব বা দুঃখ প্রকাশ করি, তখন কি আমরা সে প্রকৃত ভালোবাসা ও আনুগত্যের কথা চিন্তা করি? না আমরা মিষ্টি খাওয়া বা একটা আনুষ্ঠানিক প্রথাই পালন করি। হ্যাঁ, মিষ্টি খাওয়াও সুন্নত বটে! তবে কথা হলো, আমরা বর্তমানে শুধু মিষ্টিজাতীয় সুন্নতগুলো পালনে অতিমাত্রায় যত্নশীল হয়ে পড়েছি। কিন্তু কতগুলো সুন্নতের কথা আমরা একেবারেই ভুলতে বসেছি। যেমন- দুস্থ ও আর্তদের সেবা করা, গরিব-দুঃখীর দেখাশোনা করা ও মানবকল্যাণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করা। উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়া আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যা রাসুল (সা.) করেছেন ও করতে বলেছেন; সেগুলো আমাদের জন্য সুন্নত এমকি অনেক ফরজও বটে। কিন্তু আমরা সে সম্পর্কে উদাসীন। যেটুকু করি, সেটুকুও কি পরিপূর্ণ করতে পারি? না; বরং শুধু যে কোনো একটা দিক নিয়েই আত্মপ্রসাদ লাভ করি। এমনকি, ক্ষেত্র বিশেষ নিজের কর্মপরিধি বাড়ানোর পরিবর্তে অন্যসবার সমালোচনা করে তৃপ্তি লাভ করি। যার দরুন নিজের অসম্পূর্ণতা ও অন্যের অসহযোগিতার ফলে পরাভূত হই বারবার। মিলাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, জন্মলগ্ন বা জন্ম সম্পর্কে আলোচনা। আমাদের পরিভাষায় মিলাদ বলতে বুঝি, প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম ও জীবনী আলোচনা এবং তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করা। এ প্রসঙ্গে কোরআনুল কারিমে বর্ণিত হয়েছে, 'নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুল (সা.) এর প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতারা তাঁর প্রতি রহমতের দোয়া করেন; হে বিশ্বাসীরা! তোমরা তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ ও যথাযথরূপে সালাম পেশ করো।' (সূরা আহজাব : ৫৬)। এ বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কাব্যগ্রন্থ, পুঁথি-পুস্তক, গল্প-উপন্যাস, কল্পকাহিনী, ছড়া-ছন্দ, পদ্য-গান, লিখিত হয়েছে। লেখা হচ্ছে আরও অনেক লিখিত হবে। এর তাৎপর্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, আরও হবে। তবুও এটা নিশ্চিত যে, সব ব্যাখ্যার সার ব্যাখ্যা, সব কথার সার কথা যাতে সবাই একমত যে, মিলাদুন্নবি (সা.) এর মূল শিক্ষা হলো একমাত্র কালেমা তায়্যিবা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আল্লাহ ভিন্ন উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর প্রেরিত রাসুল।' এ কালেমার গূঢ়ার্থ হাজারো ধরনের বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ অথচ অতি সংক্ষিপ্ত ও অতি নিখুঁত বিশ্লেষণ হলো ঈমানে মুজমাল- 'বিশ্ব প্রভু আল্লাহর প্রতি আমি ঈমান আনলাম, তাঁর সব আদেশাবলি মেনে নিলাম।' মোদ্দাকথা, মিলাদুন্নবী (সা.) এর আসল শিক্ষা হলো- মহানবী (সা.) এর ২৩ বছরের ভালোবাসার, কঠোর সাধনার পরিপূর্ণ ও একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম বা জীবনবিধান ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে সর্বস্তরে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শান্তির ধর্ম ইসলামকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠা করা। আর এটাই নবী বা রাসুল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য; যা পবিত্র কোরআনে বারবার বিবৃত হয়েছে- 'তিনি সে মহান প্রভু, যিনি রাসুল প্রেরণ করেছেন, সঠিক পন্থা ও সত্য ধর্ম সহযোগে, যাতে সে ধর্মকে প্রকাশ করতে পারেন সর্ব ধর্মের শিখরে।' (সূরা তওবা : ৩৩/সূরা ফাতহ : ২৮)।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়