Wednesday, December 16

ইসলামে স্বাধীনতা ও বিজয়


মুফতি শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: মানুষ সৃষ্টিগত ও জন্মগতভাবে স্বাধীন। স্বাধীনতা মানুষের মজ্জাগত, এটি মৌলিক অধিকারের একটি। মানুষ মনোজগতে সবসময় স্বাধীন; তাই মানুষ বস্তুজগতেও স্বাধীন থাকা পছন্দ করেন। মানবতার মুক্তিদূত প্রিয়নবী (সা.) বলেন, 'প্রত্যেক নবজাতক স্বভাব ধর্মে জন্মে; তার বাবা-মা তাকে বিভিন্ন শৃঙ্খলাবদ্ধ করে।' (মুসলিম)। মানুষ আল্লাহ ছাড়া কারও গোলামি করবে না, করবে না কারও দাসত্ব; এক আল্লাহর প্রভুত্ব ছাড়া কারও প্রভুত্ব স্বীকার করবে না; হোক সে নমরুদ-ফেরাউন বা কোনো দেব-দেবতা। জগতের সব মানুষ একই মা-বাবার সন্তান। সবারই পিতা বাবা আদম (আ.)। সবারই মাতা মা হাওয়া (আ.)। তাই সব মানুষ ভাই ভাই, তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। সাদা-কালো, লম্বা-খাটো সে তো আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতির অবদান। বর্ণবৈষম্য, ভাষাবৈষম্য এবং ভৌগোলিক ও নৃতাত্তি্বক পার্থক্য মানুষে মানুষে কোনো প্রভেদ তৈরি করে না। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মোত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।' (সূরা হুজরাত : ১৩)। বিদায় হজের ভাষণে নবী করিম (সা.) বলেছেন, 'কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।' (বোখারি)। অর্থাৎ কেউ কারও ওপর প্রভুত্ব কায়েম করতে পারবে না। সবার একমাত্র প্রভু মহান আল্লাহ। ইসলামের মূল বাণী পবিত্র কালেমায় এ ঘোষণাই দেয়া হয়েছে, 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।' অর্থাৎ 'এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রভু নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল।' এ ঘোষণার পর মানুষ, মানব-দানব সব ধরনের প্রভুর গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং আদর্শ হিসেবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ (সা.) কে গ্রহণ করে। স্বাধীনতা যেমন মানুষের মৌলিক অধিকার, তেমনি ইসলামের মূল শিক্ষা। তাই রাসুল (সা.) শুধু দাসমুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি; তিনি দাসকে সন্তান বানিয়েছেন। তিনি কৃতদাসকে ভাইয়ের মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছেন। তিনি গোলামকে সেনা অধিনায়ক বানিয়েছেন। বংশানুক্রমিক দাসানুদাস আফ্রিকান নিগ্রো হাবশি বেলাল (রা.) কে মসজিদে নববির প্রধান মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে আরব-অনারব, ধনী-দরিদ্র সবাই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন। রোম পারস্যসহ পৃথিবীতে ইসলামের স্বাধীনতার বাণী বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত বর্ষের শ্রেণিবৈষম্য ও বর্ণবৈষম্যের শিকার নির্যাতিত নিপীড়িত কোটি কোটি মানব সন্তান স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করার জন্য পবিত্র কালেমার শরাবান তহুরা পান করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছেন। মুক্তির সুধা পান করেছেন বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। স্বাধীনতা মানে সত্য প্রকাশের, সত্য গ্রহণের, সত্য প্রচারের স্বাধীনতা, সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে চলার। স্বাধীনতা হলো সুন্দর, সুশীল, সুকুমারবৃত্তি চর্চার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে অসুন্দরকে বর্জন করার স্বাধীনতা, অসত্যকে অগ্রাহ্য করার স্বাধীনতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা। দিনের পর রাত আসে, ভারতের মুক্ত আকাশে নেমে আসে অন্ধার অমানিশা। ভারতের জনগণ আবার ব্রিটিশের জালে বন্দি হয়, হারায় তাদের স্বাধীনতা। মুক্তির জন্য ছটপট করে চিন্তাশীল ও বিবেকসম্পন্ন জনগণ। কালক্রমে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়। যার নেতৃত্বের শিরোভাগে অন্যান্যদের সাথে ছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জাওহার, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা শিব্বির আহমাদ উসমানী, মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী, মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি, মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা মুহাম্মাদ আলী প্রমুখ। স্বাধীনতা অর্জন হলেও ইসলামের নামে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তান মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর অপকৌশলে ইসলামের প্রকৃত মুক্তির স্বাদ জনগণকে উপহার দিতে পারেনি। ফলে ইয়াহিয়া, টিক্কা, আইয়ুব ও ভুট্টোর মতো নরাধমেরা আবার পূর্ব পশ্চিমের পার্থক্য তৈরি করল; বাঙালি আর পাঞ্জাবির মধ্যে মনস্তাত্তি্বক দেয়াল সৃষ্টি করল। বাঙালি যেন স্বাধীন হয়েও আবার পরাধীন হলো। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হলো। এ আন্দোলনেও বাঙালি জিতল। মাতৃভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়; কারণ সব ভাষাই আল্লাহর দান। কোরআনে রয়েছে, 'আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই অনেক নিদর্শন রয়েছে।' (সূরা রোম : ২২)। তারপরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জনমতের বিপরীতে অবস্থান করে আবার মুক্তিপাগল জনগণকে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। কিন্তু এদেশের জনগণ যাদের ঈমানে মুক্তির বাণী, বিশ্বাসে স্বাধীনতার ধ্বনি, তারা তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাস যুদ্ধের পর পরাজয়বরণ করে জালেম শাহী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে মুক্তিকামী জনগণ। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। আমাদের প্রিয় হাবিব বিশ্বনবী (সা.) যখন মক্কা বিজয় করেন, তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নির্দেশনা প্রদান করেন, 'যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেবেন, তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন; তিনি তো তওবা কবুলকারী।' (সূরা নাসর : ১-৩)। বিজয়-পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, 'আমি তাদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে, আর সব কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারে।' (সূরা হজ : ৪১)। মহান আল্লাহ আমাদের স্বাধীনতা কেয়ামত পর্যন্ত অক্ষুণ্ন রাখুন, মুক্তির প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের তৌফিক দান করুন এবং বিজয়-পরবর্তী করণীয় অনুধাবন ও প্রতিপালনের সুযোগ করে দিন।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়