Wednesday, December 23

আরবি জীবন্ত ভাষা


মুশাহিদ দেওয়ান: ভাষা আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ দান। মানুষের জীবনের সব চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-কল্পনার প্রকাশমাধ্যম হচ্ছে ভাষা। ভাষা দিয়ে আমরা প্রকাশ করি স্নেহ-ভালোবাসা, ঘৃণা-বিদ্বেষ, সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার অনুভূতি। আল্লাহ তায়ালা ভাষার নেয়ামত দিয়ে পৃথিবীর অন্য সব প্রাণী থেকে মানবজাতিকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। প্রত্যেক জাতির স্বতন্ত্র ভাষা আছে। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পৃথিবীতে প্রায় ৭ হাজার ভাষা আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অনেক ভাষা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। আরবি পৃথিবীর একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অত্যন্ত সমৃদ্ধ জীবন্ত ভাষা। ২৬টি রাষ্ট্রের সরকারি ভাষা। প্রায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ মানুষের মাতৃভাষা এবং প্রায় দেড় শত কোটি মুসলিমের ধর্মীয় ভাষা। এ ভাষায় নাজিল হয়েছে মানবজাতির দিশারি পবিত্র কোরআন। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.) এর ভাষাও আরবি। ইসলাম ধর্মের মূল উৎস কোরআন-হাদিস আরবিতে হওয়ায় এর মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। তাছাড়া এ ভাষায় প্রণীত হয়েছে ইসলামের অসংখ্য ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এজন্য ইসলামী জ্ঞানার্জনের জন্য আরবি জানা একটি অপরিহার্য বিষয়। তাই মাতৃভাষা না হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমবিশ্বের সর্বত্র তা পঠিত ও চর্চা হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তার রয়েছে আন্তর্জাতিক মর্যাদা। ইসলামে আরবি ভাষার মর্যাদা ইসলামে আরবি ভাষার মর্যাদা কত ঊর্ধ্বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার প্রধান কারণ হচ্ছে, মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আমি এ কিতাবকে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পারো।' (সূরা ইউসুফ : ২)। অন্যত্র এরশাদ করেন, 'এ কোরআন সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে।' (সূরা শুআরা : ১৯৫)। এভাবে হাদিসে এসেছে, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) বলেন, 'তোমরা আরবিকে তিনটি কারণে ভালোবাসো। কেননা আমি আরবিভাষী, কোরআনও আরবি এবং জান্নাতিদের ভাষাও হবে আরবি।' (বায়হাকি : ১৩৬৪)। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তোমাদের যে সুন্দরভাবে আরবি ভাষায় কথা বলতে পারে সে যেন ফার্সি (তথা অনারবি) ভাষায় কথা না বলে। কেননা তা নিফাক সৃষ্টি করে। (জামিউল আহাদিস : ৪৫৩৬০)। আরবি ভাষার গুরুত্ব প্রসঙ্গে ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, 'আরবি ভাষা বর্জন করার কারণেই লোকজন মূর্খ হয়েছে এবং বিভিন্ন মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যদি তারা ভালোভাবে আরবি জানত তাহলে ধর্মীয় ব্যাপারে সব সংশয়, সন্দেহ, মতবিরোধ এমনিতেই নিঃশেষ হয়ে যেত।' বিখ্যাত বুজুর্গ হাসান বসরি (রহ.) বলেন, 'বেদআত সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে আরবি ভাষা ভুলে যাওয়া। মানুষকে অনারব ভাষা ধ্বংস করে দিয়েছে।' আরবি খুব সহজ ভাষা আরবি অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সহজ ভাষা। যে কেউ এটিকে সহজেই আয়ত্ত করতে সক্ষম। এ প্রসঙ্গে কোরআনে এসেছে, 'আমি এ কোরআনকে তোমার ভাষায় (তথা আরবি ভাষা) সহজ করেছি যাতে করে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।' (সূরা দুখান : ৫৮)। মুসলিম জীবনে আরবির আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মীয় আচারে আরবি উচ্চারণ করা ছাড়া বিকল্প নেই। ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করতে হয় আরবিতে। ঈমান গ্রহণের পর গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ, যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আরবিতে সমাপ্ত করতে হয়। তাই আরবি বিশুদ্ধভাবে না পড়তে পারলে ইবাদত হয় না। এ প্রয়োজনে পৃথিবীর প্রত্যেক মুসলিমকেই শুদ্ধ আরবি শিখতে হয়। আরবি ভাষা ও সাহিত্যে কোরআনের অবদান মূলত পবিত্র কোরআনই আরবি ভাষাকে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে রেখেছে। তাকে সজীবতা দিয়েছে। কোরআনের প্রভাব ও শক্তির কারণে আরবি জগতের অন্য ভাষার মতো কালের গর্ভে হারিয়ে যায়নি। বিশ্বের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ভাষায় পরিণত হয়েছে। তারা কোরআন পড়ার জন্য আরবি শিখছেন। চর্চা করছেন। তাছাড়া আরবি ভাষার সংস্কারও করেছে পবিত্র কোরআন। কোরআনকে বারবার পাঠ করার ফলে আরবদের ভাষা সুশ্রাব্য, সুসামঞ্জস্য ও সাহিত্যম-িত হয়েছে। আরবি ভাষা ও সাহিত্যের বর্তমান অবস্থান আরবি সাহিত্য প্রায় ২ হাজার বছরের প্রাচীন সাহিত্য। ইবরাহিম (আ.) এর তনয় ইসমাঈল (আ.) এর ভাষা ছিল আরবি। মধ্যযুগে আরবি ভাষাতেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন, শিক্ষা ও গবেষণা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ধর্মীয় সাহিত্য আরবিতে রচিত হয়েছে। প্রাচীনকালের মতো আরবি ভাষা ও সাহিত্য বর্তমানেও অনেক উন্নত এবং তার তারুণ্য ধরে রেখেছে। ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৮তম অধিবেশনে আরবি ভাষাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এ ঐতিহাসিক দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই পরবর্তী সময়ে ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবি (রহ.) এর ভাষায়, আরববিশ্বে ভাষা ও সাহিত্যের মান এখন এত উন্নত এবং সংবাদপত্র ও প্রকাশনা বিপ্লবের সুবাদে ভাষার সমৃদ্ধ ভা-ার এত সর্বজনীন যে, আরবিতে কলম ধরার জন্য এখন বিরাট প্রস্তুতি ও চর্চা সাধনার প্রয়োজন। আরববিশ্বে আরবি ভাষা এখন তার পূর্ণ জোয়ার ও যৌবনকাল অতিক্রম করছে। বিশ্বসভায় আরবি ভাষা এখন আইন ও সংবিধান, জ্ঞান ও দর্শন, সাহিত্য ও সংবাদপত্র এবং রচনা ও গবেষণার ভাষা রূপে সর্বোচ্চ মর্যাদায় সমাসীন। (জীবন পথের পাথেয়)। প্রফেসর ড. সিরাজুল হকের মতে, বিশ্ব সাহিত্যে আরবি সাহিত্যের স্থান অতি উচ্চে। অন্যপক্ষে আরবি ভাষাও একটি জীবন্ত ভাষা। আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগের আরবি কবিতার ভাষা ও ভাব এখনও আমাদের বোধের আয়ত্তে এবং সাহিত্যপিপাসুদের জন্য রস ও আনন্দের এক চিরন্তন উৎস। (আরবি সাহিত্যের ইতিহাস)। আরবিচর্চার দৈন্যদশা ও উত্তরণের পথ বাঙালি জাতির আরবি ভাষার সঙ্গে পরিচয় হয় সুদৃঢ় প্রাচীনকালে। এদেশের সঙ্গে আরব বণিকদের বাণিজ্য সম্পর্ক প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। ইসলাম আবির্ভাবের পর আরব বণিকরা বাণিজ্য নিমিত্ত এদেশে আসতেন। তাদের সঙ্গে ধর্মপ্রচারক সুফি-সাধকরাও আসতেন। তারা এ দেশে ইসলাম প্রচার করেন। তাদের ব্যবসা ও ধর্মপ্রচারের ফলে বাংলা ভাষাতে আরবি মিশে যায়। এক পরিসংখ্যান মতে, বন্দরনগরী বৃহত্তম চট্টগ্রামের উপভাষার মোট শব্দের প্রায় অর্ধেক আরবি ও আরবি শব্দজাত। প্রাচীনকাল থেকেই আরবির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকলেও এখনও মানসম্মত আরবি চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। দেশে ইংরেজি শিক্ষার যে মানের প্রতিষ্ঠান আছে আরবি শিক্ষার তেমন মানসম্মত প্রতিষ্ঠান নেই। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আরবি চর্চার গুরুত্ব অনেক। ধর্মীয় ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি ধনী আরব দেশগুলোতে কর্মের সন্ধানে, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে গমনকারীদের আরবি ভাষাচর্চার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এদেশের শতকরা ৯০ শতাংশ রেমিট্যান্স বা বৈদেশিক মুদ্রা আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। প্রতি বছর হাজার হাজার বাঙালি কর্মের সন্ধানে মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছেন। কিন্তু আরবি ভাষা দক্ষতার অভাবে অন্যান্য দেশের লোকের মতো সম্মানজনক কর্মসংস্থান ও বেতন পান না। এভাবে মুসলিমবিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে আরবি ভাষা চর্চার পরিধি সমৃদ্ধ না করে উপায় নেই। ধর্মীয়, সামাজিক, শিক্ষা ও উন্নয়নমূলক কাজে আরবদাতাদের অনুদান পেতে হলে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে আরবি দক্ষতার পরিসংখ্যান হতাশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা তথ্যে সরকারি মাদরাসার ৬১ শতাংশ শিক্ষক আরবিতে দক্ষ নন। কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ব্যতিক্রম নয়। উভয় ধারার মাদরাসা সিলেবাসে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী মানসম্মত আরবি বলতে ও লিখতে পারেন না। তারা আধুনিক বিশ্বে প্রচলিত আরবি রীতি শৈলীর সঙ্গে পরিচিত নন। এ দৈন্যদশা দূর করতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সৃজনশীল বিজ্ঞানসম্মত আরবি চর্চার পরিধি বাড়াতে হবে। সৌদি-কাতারের Arabic Program for Non-Native Speakers (মাহাদ লুগাতিল আরাবিয়া লি গায়রি নাতিকিনা বিহা) তথা অনারবিদের আরবি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাস ও শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের দেশে প্রয়োগ করতে হবে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আধুনিক প্রচলিত আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়