ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
আল্লামা ইকবাল ক্যাম্পাস পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়, পাকিস্তান
আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮) উর্দু ও ফারসি ভাষার বিশ্ববিখ্যাত কবি ও দার্শনিক। তার কাব্যসমগ্রের দুই-তৃতীয়াংশ রচিত হয়েছে ফারসি ভাষায়, মাত্র এক-তৃতীয়াংশ লিখেছেন তার মাতৃভাষা উর্দুতে। কবির চেয়েও দার্শনিক হিসেবে ইকবালের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। গবেষকদের মতে, গত ৫০০ বছরে সমগ্র মুসলিমবিশ্বে ইকবালের সমকক্ষ কোনো দার্শনিক জন্মাননি।
আল্লামা ইকবাল পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ আর প্রাচ্যে দুনিয়া বিসর্জনের সুফিবাদ- এ দুই প্রান্তিক মতবাদের মাঝখানে নতুন জীবন-দর্শন উপস্থাপন করে মানব সভ্যতার সামনে একটি মাইলফলক স্থাপন করেন, যা খুদি (আত্মসত্তা) দর্শন নামে প্রসিদ্ধ। অর্থাৎ 'আমি নিজে আছি' এ কথা অনস্বীকার্য সত্য। কাজেই আমার নিজস্ব অস্তিত্ব আছে। তাই আমার স্রষ্টাও আছেন এবং স্রষ্টার সূত্রে জগতের সবকিছুই অস্তিত্ববান। একই যুক্তিতে এ বিশ্বে আমার দায়িত্ব আছে এবং সে দায়িত্ব সূত্রে এখানে আমার অবস্থান হলো, আমি পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা। আল্লাহর অভিপ্রায় বাস্তবায়ন ও আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী পৃথিবীকে সাজানোর দায়িত্ব নিয়ে আমি পৃথিবীতে এসেছি।
ইকবাল তার এ বিস্ময়কর চিন্তা-দর্শনের রসদ সংগ্রহ করেছেন কোরআন মজিদ থেকে। কোরআন মজিদের বড় বিশেষজ্ঞ না হয়েও প্রাণের সবটুকু আবেগ দিয়ে প্রত্যহ কোরআন তেলাওয়াত তাকে মহাকবি ও কালজয়ী চিন্তানায়কে পরিণত করেছিল। বাবার উৎসাহে ইকবাল কোরআন মজিদ হতে এমন অতুলনীয় সম্পদ কীভাবে সংগ্রহ করেন, সে তথ্য বড় চমৎকার ও তাৎপর্যপূর্ণ।
উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম মনীষী মওলানা সুলায়মান নদভী ইকবালসহ আফগানিস্তান সফরে গিয়েছিলেন। সেই সফরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ইকবালের ছোটবেলার একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, 'কাবুল সফর থেকে ফেরার পথে কান্দাহারের বালুরাশির বিশাল প্রান্তর অতিক্রম করছি। সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের পাহাড়ের ওপর আমাদের গাড়িগুলো দৌড়াচ্ছিল। সন্ধ্যা নেমেছিল। আমরা দুইজন একই গাড়িতে বসা ছিলাম। আধ্যাত্মিকতা নিয়ে কথাবার্তা চলছিল। আলোচনা হচ্ছিল দিব্যদৃষ্টির বুজুর্গদের প্রসঙ্গ নিয়ে। এ সময় তিনি বড় আবেগ নিয়ে নিজের জীবনের দুইটি ঘটনা বর্ণনা করলেন। আমার মতে এ দুইটি ঘটনা তার (ইকবালের) জীবনের যাবতীয় সুকীর্তির আসল বুনিয়াদ।' তিনি বলেন, আমি যখন শিয়ালকোটে পড়ালেখা করছিলাম, তখন ভোরবেলা উঠে প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াত করতাম। মরহুম ওয়ালেদ সাহেব (বাবা) তার নিয়মিত দোয়া-দরুদ থেকে অবসর হয়ে আসতেন এবং আমাকে দেখে চলে যেতেন। একদিন ভোরে তিনি আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মুচকি হেসে বললেন, 'কখনও সুযোগ হলে আমি তোমাকে একটি কথা বলব।'
কথাটি বলার জন্য আমি দুই-তিনবার অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, 'যখন পরীক্ষা দিয়ে নেবে, তখন।'
যখন আমি পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম এবং লাহোর থেকে ঘরে এলাম, তখন বললেন, 'যখন পাস করবে।'
পাস করার পর জিজ্ঞেস করলাম। তখন বললেন, '(ঠিক আছে) বলব।'
একদিন ভোরে যখন নিয়মমাফিক কোরআন তেলাওয়াত করছিলাম, তখন তিনি আমার কাছে এলেন এবং বললেন, 'বেটা বলছিলাম যে, তুমি যখন কোরআন পড় তখন এরূপ বুঝ যে, কোরআন তোমার উপরই নাজিল হচ্ছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তোমার সঙ্গে কথা বলছেন।'
ইকবাল বলছিলেন যে, তার এ উক্তি আমার অন্তরের মধ্যে বসে যায়। আর তার স্বাদ অন্তরে এখন পর্যন্ত অনুভব করছি। এটিই ছিল সেই বীজ, যা ইকবালের অন্তরের মধ্যে বপন করা হয় আর তার পল্লবিত শাখা-প্রশাখা জগতের বিশাল আঙিনায় মধুর বচনামৃতরূপে ছড়িয়ে আছে। (ইকবাল অউর কোরআন, ড. গোলাম মুস্তফা খান)।
ইকবাল গবেষক ইবাদুল্লাহ ফারুকী লিখেছেন, আল্লামা ইকবাল তার বিখ্যাত 'খুতবাত' এর এক জায়গায় বলেন, সুফিয়ায়ে কেরামের মধ্যকার একজন বুজুর্গ বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মোমিনের অন্তরের ওপর কিতাব (কোরআন মজিদ) সেভাবে নাজিল না হবে, যেভাবে রাসুল (সা.) এর ওপর নাজিল হয়েছিল তাহলে তাকে বোঝা সম্ভব নয়। ... ইকবাল তার অনবদ্য রচনা 'বালে জিব্রিল' (জিবরাঈলের ডানা) এর মধ্যে এ অভিব্যক্তিটি এভাবে ব্যক্ত করেছেন-
'তোমার অন্তকরণে যতক্ষণ না হবে অবতরণ কিতাবের, জট খুলতে পারবে না রাজি কিংবা রচয়িতা কাশশাফের।'
রাজি মানে বিখ্যাত বিশাল তাফসির গ্রন্থ 'তাফসিরে কবির' এর রচয়িতা ইমাম ফখরুদ্দীন রাজি। আর 'রচয়িতা কাশশাফের মানে ইসলামী জাহানে কোরআন মজিদের অলৌকিত্বের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে সর্বমহলে সমাদৃত তাফসির গ্রন্থ 'কাশশাফ' এর রচয়িতা আল্লামা জারুল্লাহ জামাখশারি। ইকবাল বলছেন যে, কোরআন তেলাওয়াতকারীর অনুভবে যদি এখনই কোরআন তেলাওয়াত হচ্ছে এমন উপলব্ধি না আসে তাহলে ইমাম রাজি বা আল্লামা জামাখশরির তাফসির পড়লেও তোমার অন্তরের জট খুলতে পারবে না।
হৃদয়ের জ্বলন ও আসক্তি নিয়ে ইকবাল কোরআন তেলাওয়াত করতেন। তিনি পড়তে থাকতেন আর কেঁদে সারা হতেন। এমনকি কোরআন মজিদের পাতাগুলো একেবারে ভিজে যেত। আর তা রোদে শুকানো হতো। তিনি যে কোরআন মজিদটি নিয়মিত তেলাওয়াত করতেন, তা লাহোরের ইসলামিয়া কলেজের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে এবং এ বর্ণনার বাস্তব প্রমাণ হয়ে রয়েছে। (প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০)।
কোরআন মজিদ কতখানি গভীর মনোযোগ ও হৃদয়ের আবেগ ও একাগ্রতা নিয়ে তেলাওয়াত করা উচিত তা বিভিন্ন রেওয়ায়াত থেকেও অনুমান করা যায়। যেমন- এ মর্মে সুনানে দারামিতে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত আতিয়া (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহর কাছে তার কালাম (কোরআন) এর চেয়ে মর্যদাসম্পন্ন আর কোনো বাক্য নেই। আর এমন কোনো বাক্য বান্দাকে আল্লাহর সানি্নধ্য দান করেনি, যা তার কাছে তার কালামের চেয়ে অধিক প্রিয়। (সুনানে দারামি)।
কোরআনে হাকিমে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, 'নিশ্চয়ই মোমিন তারা, আল্লাহর কথা স্মরণ করা হলে যাদের অন্তর প্রকম্পিত হয় এবং যখন তাদের কাছে তার আয়াতগুলো তেলাওয়াত করা হয় তখন তা তাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করে আর তাদের প্রভুর ওপর তারা নির্ভরশীল হয়।' (সূরা আনফাল : ২)।
এ আসক্তি নিয়ে ইকবাল অন্যদেরও কোরআন তেলাওয়াতের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। যেমন নিয়াজ উদ্দীন খানকে লেখা এক পত্রে ইকবালের এ দৃষ্টিভঙ্গি এভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
'কোরআন বেশি বেশি পাঠ করা চাই। যাতে অন্তর মুহাম্মদি সম্পর্ক লাভ করতে পারে। এ মুহাম্মদি সম্পর্ক (ইকবালের ভাষায় নিসবতে মুহাম্মদিয়া) লাভ করার জন্য কোরআনের অর্থও জানতে হবে, তা জরুরি নয়। হৃদয়ের নিষ্ঠা নিয়ে শুধু পাঠ করাই যথেষ্ট।'
ইকবাল ও কোরআন গ্রন্থের রচয়িতা বলেন, বিভিন্ন বুজুর্গের মত হচ্ছে, কোরআন পড়ার জন্য এটা জরুরি নয় যে, কোরআন মজিদের অর্থও জানতে হবে।
তিনি আরও লিখেছেন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) স্বপ্নে আল্লাহ তায়ালার জলওয়া দেখতে পান। তখন তিনি আরজ করলেন যে, তোমার সান্নিধ্যে পৌঁছার সবচেয়ে সহজ পথ কোনটি? জওয়াব এলো, কোরআন পাঠ করবে। তারপর আরজ করলেন, কোরআন কি অর্থ বুঝে পড়া হবে, নাকি অর্থ না বুঝেও। জবাব এলো যে, উভয় প্রকারে।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়