Tuesday, November 17

ফ্রান্স হামলায় জড়িত সন্দেহভাজনরা


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলাকারী সাতজনের নাম আসছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। এদের চারজনকে শনাক্তের কথা জানিয়েছে ফারিস পুলিশ। এদের মধ্যে একজন পলাতক বলে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছে। ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ যে চারজনের নাম প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে তিনজন নিহত হয়েছে। সাত হামলাকারীর সঙ্গে আসছে আরও একজনের নাম, যিনি সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি থেকে আক্রমণের ছক এঁকেছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। সন্দেহভাজন এই জঙ্গিদের বৃত্তান্ত তুলে ধরেছে বিবিসি ও গার্ডিয়ান। আবাউদ আবদেলহামিদ প্যারিস হামলার হোতা হিসেবে আবাউদ আবদেলহামিদ নামে ২৭ বছর বয়সী বেলজিয়ামের এই নাগরিকের কথা আসছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইসলামিক স্টেটে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা এই যুবক এখন সিরিয়ায় অবস্থান করছেন। গত অাগস্টে প্যারিসে দ্রুতগতির একটি ট্রেনে হামলা এবং এপ্রিলে একটি চার্চে বানচাল হয়ে যাওয়া হামলা পরিকল্পনার সঙ্গেও আবাউদের যোগসূত্র পাওয়ার দাবি করেছে ফরাসি কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি সিদ আহমেদ গলাম নামে ফ্রান্সের এক শিক্ষার্থীকে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। দেশটির পত্রিকা লিবারেশনের দাবি, গলামের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল আবাউদের। পত্রিকাটির দাবি, গলামের ঘরে যেসব কাগজপত্র পাওয়া গেছে এবং তার কম্পিউটার ও টেলিফোনের তথ্য অনুসন্ধান করে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা থেকে জানা যায়, সিরিয়ায় এমন একজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল, যিনি ফরাসি ভাষা বলতে পারেন। সিরিয়ার ওই ব্যক্তিই তাকে চার্চে হামলা করতে বলেছিলেন। প্যারিসের বিদ্রুপ ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর জানুয়ারিতে ফরাসি কর্তৃপক্ষ আবাউদকে বেলজিয়ামের একটি সন্ত্রাসী সেলের হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং চক্রটিকে ধ্বংসের চেষ্টা চালায়। ওই সময় সন্ত্রাস দমন বিভাগের অভিযানে বেলজিয়াম থেকে ১৩ জঙ্গিকে আটক করা হয়। যদিও আবাউদ থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। চলতি বছরের শুরুতে বেলজিয়ামের গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে জানা যায়, আবাউদ সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের হয়ে যুদ্ধ করছেন। আইএসের প্রকাশিত একটি ভিডিওতে তাকে দেখার পর বেলজিয়ামের নিরাপত্তা বাহিনী তার সম্পর্কে জানতে পারে। ওই ভিডিওতে একটি গাড়ির চাকা দেখা যায়; যে গাড়িতে করে আবাউদ ক্ষত-বিক্ষত লাশের স্তূপ নিয়ে গণকবরের দিকে যাচ্ছিলেন। ফ্লেমিশ ভাষার চ্যানেল 'ভিটিএম' তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, জানুয়ারিতে বেলজিয়ামের ভারভিয়ার্স শহরে সন্ত্রাস দমন অভিযানের সময় অস্ত্রধারী দুই জঙ্গি নিহত হন। তাদের একজন আবাউদের ভাই এবং গ্রিস থেকে আবাউদ তার ভাইকে ফোনও করেছিল। ফেব্রুয়ারিতে আইএসের অনলাইন সাময়িকী ‘দাবিক’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দম্ভের সঙ্গে আবাউদ বলেছিলেন, তিনি বেলজিয়ামের গোয়েন্দা সংস্থার নাকের ডগা দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে হামলার পরিকল্পনা করতে সক্ষম হয়েছেন। আবাউদ আবু উমর আল-বালজিকি নামেও পরিচিত। আবাউদ আইএসের হয়ে যুদ্ধ করছেন এরকম একটি ছবিও বেলজিয়ামের গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। এরপর হামলা পরিকল্পনা করতে ইউরোপে গেলে এক পুলিশ কর্মকর্তা তাকে আটকে ছিল বলেও দাবি করেন তিনি। বলেন, 'ওই সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে থামালেও পরে সে আমাকে যেতে দেয়। কারণ সে ছবির সঙ্গে আমার চেহারায় মিল খুঁজে পায়নি।' তবে কোথায় এবং কখন পুলিশ তাকে আটকে ছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বেলজিয়ামে বসবাস করার সময় গোয়েন্দা সংস্থার হুলিয়া মাথায় নিয়েই তিনি পশ্চিমা দেশে হামলার পরিকল্পনা করেন বলে জানান আবাউদ। এর কিছুদিন পর তিনি সিরিয়া চলে যান। উমর ইসমাইল মস্তেফা ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ হামলাকারীদের মধ্যে এই নামটিই প্রথম প্রকাশ করে। আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত ২৯ বছর বয়সী এই যুবক প্যারিসের দক্ষিণে কুহকুহন অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন। পুলিশের খাতায় তার বিরুদ্ধে ছোটখাটো অপরাধের রেকর্ড আছে। বাতাক্লঁ কনসার্ট হলে খুঁজে পাওয়া একটি বিচ্ছিন্ন আঙ্গুল থেকে তার পরিচয় শনাক্ত করা হয়। বলা হচ্ছে, নিহত জঙ্গিদের একজন তিনি। ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, ২০১০ সালে থেকেই মস্তেফার উপর নজর ছিল ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থার। ওই সময় তিনি চরমপন্থিদের যাতায়াত আছে এমন একটি মসজিদে বেশি সময় কাটানো শুরু করেন। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে গোয়েন্দারা তাকে আর খুঁজে পায়নি। ধারণা করা হয়, তখন তিনি সম্ভবত সিরিয়া চলে গিয়েছিলেন। তুরস্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১৩ সালে মস্তেফা তুরস্ক প্রবেশ করেন। কিন্তু তার সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো তথ্য নেই। মস্তেফার ভাই, বাবা ও ভাবিকে জিজ্ঞসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ। তার ভাইয়ের দাবি, কয়েক বছর ধরে তাদের সঙ্গে মস্তেফার কথাও হয়নি। তুরস্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, গত বছর ‌১০ অক্টোবর ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ মস্তেফা সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করার পর তারা ২০১৪ সালের ডিসেম্বর ও এ বছর জানুয়ারিতে তার সম্পর্কে জানিয়েছিল। কিন্তু প্যারিসে হামলার আগে আর কখনও ফ্রান্সের পক্ষ থেকে মস্তেফা সম্পর্কে তুরস্কের কাছে আর কিছু জানতে চাওয়া হয়নি। সালাহ আবদেস্লাম ধারণা করা হচ্ছে, সালাহ আবদেস্লাম হামলা চালিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছে। ২৬ বছর বয়সী এই যুবককে এখন সারাবিশ্বের পুলিশই খুঁজবে। তার বিরুদ্ধে রোববার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, খুব সম্ভবত আব্দেস্লামই কালো ফোক্সওয়াগনটি ভাড়া করেছিল। ওই গাড়িতে করেই হামলাকারীরা বাতাক্লঁ কনর্সাট হলে যায়। আবদেস্লামের জন্ম বেলজিয়ামে, বেড়ে ওঠাও। ফ্রান্স পুলিশ বলছে, তিনি একজন ভয়ানক ব্যক্তি। প্যারিসে হামলার কয়েক ঘণ্টা পর ফ্রান্স পুলিশ বেলজিয়াম সীমান্তে আবদেস্লাম ও আরও দুই ব্যক্তিকে থামিয়ে ছিল। কিন্তু তল্লাশি করলেও কোনো পরোয়ানায় নাম না পেয়ে তাদের সীমান্ত অতিক্রমের অনুমতি দেওয়া হয়। ব্রাহিম আবদেস্লাম পালিয়ে যাওয়া হামলাকারী সালাহ আবদেস্লামের ভাই ৩১ বছর বয়সী ইব্রাহিম। বলিভার্দ ভলতেয়ার ক্যাফেতে তিনি আত্মঘাতী বোমা হামলা চালান বলে মনে করা হচ্ছে। গোয়েন্দারা বলছেন, ব্রাহিম একটি সিয়াট গাড়ি ভাড়া করেছিলেন। ওই গাড়িটি পরে পাওয়া যায় এবং তার ভেতরে অস্ত্র ছিল। ব্রাহিম আর আবাউদ বেলজিয়ামের মলেনবিক শহরে থাকতেন। ব্রাসেলসের কাছের এই শহরটিতে অনেক মুসলিম রয়েছে। বলা হচ্ছে, এটা ‘জিহাদি উৎপাদনের খামার’। আবাউদের সঙ্গে কয়েকটি মামলায় ব্রাহিমের নামও রয়েছে। মোহামেদ আবদেস্লাম সালাহ ও ব্রাহিমের ভাই মোহামেদ আবদেস্লামকে প্যারিসে হামলার পর মলেনবিক থেকে ধরেছিল বেলজিয়াম পুলিশ। কিন্তু সোমবার তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় কোনো অভিযোগ না এনেই। তার আইনজীবী দাবি করেছেন, মোহামেদ সোমবারই জানতে পেয়েছেন যে তার ভাই ব্রাহিম মারা গেছেন প্যারিসে। সামি আমিমউর বাতাক্লঁ কনসার্ট হলের অন্য একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী হিসেবে সামি আমিমউরের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। সামির জন্ম ১৯৮৭ সালে প্যারিসে। ২০১২ সালে সামির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলা হয় এবং তাকে বিচার বিভাগের নজরদারিতে আনা হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি উধাও হয়ে যায় এবং তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গত বছর আমিমুরের বাবা মোহাম্মদ ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে সিরিয়া যান। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ফ্রান্সের একটি দৈনিকে দেওয়া সক্ষাৎকারে মোহাম্মদ বলেন, জুনে সিরিয়ায় ছেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় সে খুবই নির্লিপ্ত ছিল। আমি তাকে ফিরে আসতে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছি। ওই সময় সামি আহত ছিল এবং ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করছিল। আরও কয়েকজন ব্যক্তি সবসময় সামির সঙ্গে থাকত। তারা কখনও আমাদের একা ছাড়েনি। সামির বাবা বলেন, ছেলে যেখানে থাকত, সেখানে কখনও তাকে নিয়ে যাওয়া হয়নি এবং কীভাবে আহত হয়েছে, তাও তাকে বলেনি। সোমবার সামির স্বজন ও বন্ধুদের মধ্যে তিনজনকে আটক করেছে ফ্রান্স পুলিশ। বিলাল হাদফি আরেক হামলাকারীর হিসেবে নাম আসা বিলাল হাদফির বাস বেলজিয়ামে। তবে ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে শনাক্ত করেনি। ২০ বছর বয়সী হাদফি সিরিয়ায় আইএসের হয়ে যুদ্ধ করেছে। বেলজিয়ামের গণমাধ্যমগুলো বলছে, হাদফি ব্রাসেলসের উত্তরের কোনো এলাকা থেকে এসেছে। আহমেদ আল মোহামেদ সিরিয়ার শরণার্থীর বেশে গ্রিস হয়ে ফ্রান্সে ঢুকেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আহমেদ আল মোহামেদ প্যারিসে স্টেডিয়ামের বাইরে আত্মঘাতী হামলাকারীর লাশের পাশে সিরিয়ার একটি পাসপোর্ট পাওয়া যায়, তাতে আহমদ আলমোহাম্মদ নাম লেখা ছিল। তার বয়স ২৫, এসেছেন ইদলিব থেকে। ধারণা করা হচ্ছে, আহমেদ স্তাদে দে ফ্রঁসে স্টেডিয়ামের সামনে বোমায় নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে ওই পাসপোর্টের মালিক আর আত্মঘাতী হামলাকারী একই লোক কি না- তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ। প্যারিসের প্রসিকিউটর অফিস বলেছে, নিহত হামলাকারীর আঙুলের ছাপ গ্রিসের দ্বীপ লেরস হয়ে আসা এক শরণার্থীর সঙ্গে মিলেছে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়