Sunday, November 15

ফ্রান্স এখন কী করবে?

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর গত শুক্রবার রাতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলাটি ছিল ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরোচিত ঘটনা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া হলাদঁ এই ঘটনাকে যুদ্ধের সমান বলে উল্লেখ করেছেন এবং ফ্রান্সকে আঘাত করার পরিকল্পনা দেশের বাইরে থেকে হয়েছে বলেও তিনি জানান। তার বক্তব্যে উঠে আসে এমন কিছু দৃঢ় বক্তব্য, যা এর আগে হলাঁদের মুখে শোনা যায়নি। ‘যখন সন্ত্রাসীরা এমন ঘটনা ঘটাতে পেরেছে, তখন তাদের এটাও জানা উচিত তাদেরকেও ফ্রান্সের মুখোমুখি হতে হবে এবং ফ্রান্স তা করবেই’ এরকম বক্তব্যও দিয়েছেন হলাঁদ। কিন্তু প্রশ্ন হলো এক রাতে শহরের মোট ছয়টি স্থানে একযোগে হামলা চালিয়ে দেড়শতাধিক মানুষকে হত্যার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে হলাঁদ আসলে কী করতে পারেন?
এই ঘটনার ঠিক দশ মাস আগে প্যারিসের স্যাটায়ার কার্টুনভিত্তিক ম্যাগাজিন শার্লি হেবদোর অফিসে সন্ত্রাসীরা আরেক হামলা চালিয়েছিল। সেই হামলায় ম্যাগাজিনটির সম্পাদকসহ মোট ১৭জন নিহত হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে ওই হামলার দায়িত্ব গ্রহন করে আলকায়েদা সমর্থিত একটি দল। জানুয়ারির ওই হামলার পর প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভ্যালস ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন যে, ‘ফ্রান্স সন্ত্রাস, জিহাদিবাদ এবং মৌলবাদী ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো।’ কিন্তু গত শুক্রবারের এই হামলা পুরো বিষয়টিকেই নতুন একদিকে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আর এবারও ভ্যালস তার টুইটবার্তায় লেখেন, ‘আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে আছি। আমরা পুরো বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছি। আর এটা একটা যুদ্ধ এবং আমরা জিতবো।’
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে প্রেসিডেন্ট হলাঁদও ভ্যালসের সুরেই কথা বললেন। তিনিও এই ঘটনাকে ‘যুদ্ধ’র সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং এই যুদ্ধ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে শুরু করেছে জিহাদি সেনাবাহিনী। শুধু তাই নয়, তার ভাষায় ফ্রান্স বিশ্বের সকল স্থানেই ওই জিহাদিদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। ‘এটা স্পষ্ট যে এই যুদ্ধটি পূর্বপরিকল্পিত এবং ফ্রান্সের বাইরে থেকে একে সংগঠিত এবং পরিকল্পনা করা হয়েছে দেশিয় সহযোগিদের সহায়তায়। এটা বর্বরতার সামিল।’-হলাঁদ। শুক্রবার ঘটনা পরবর্তীতে হলাঁদ তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বলেছিলেন, ‘আমরা এই যুদ্ধে নেতৃত্বে দেবো এবং নির্মম হবো। এখানে অনেকেই আছেন যারা এই ঘটনার শিকার হয়েছেন। সন্ত্রাসীরা যখন এধরণের কাজ করতে পারে তখন তাদেরও অবশ্যই মনে রাখা উচিত ফ্রান্স তাদের মুখোমুখি দাড়াবে। একটি সম্মিলিত ফ্রান্স তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে।’
সেনাবাহিনীই সমাধান!
ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স পলিসি সেন্টারের সহকারী পরিচালক ক্রিস্টোফার চিভিসের মতে, চলতি বছরগুলোতে ফ্রান্সের কার্যক্রম বিচার করলে দেখা যাবে দেশটি বর্হিবিশ্বে সেনাবাহিনী মোতায়েনের উপর অধিক জোর দিয়েছে। এই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনটি গত এক দশকে এসেছে তখনই যখন ফ্রান্স নিজের ঘরের মধ্যকার সমস্যার সমাধান সঠিকভাবে করতে পারেনি এবং নিজের ঘরের দিকে যখন নজর দিতে হলো। চিভিস আরও বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে সন্ত্রাসের ঘাটিগুলোতে আক্রমনের ব্যাপারে ফ্রান্স হতে পারে সবচেয়ে আগ্রাসী দেশ। প্রেসিডেন্ট হলাঁদের সামর্থ্যের অভাব নেই। তার রয়েছে উন্নত বিমানবাহিনী, বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বাহিনী এবং পদাতিক ও নৌবাহিনী। ফ্রান্সের দরকার হবে ন্যাটোর মিত্র রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেলে তারা অনেককিছুই করতে পারে।’
সিএনএন’র সেনাবাহিনী বিশ্লেষক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল রিক ফ্রাঙ্কোনার মতে, এটা পরিষ্কার যে ফ্রান্স সেনাবাহিনী প্রয়োগ করবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটা ফ্রান্স কিভাবে করবে? বিমানবাহিনী দিয়ে আক্রমন চালিয়ে লক্ষ্যবস্তুগুলোতে আঘাত জানা ছাড়া আর কি করা যেতে পারে। যে সমস্যাটি আমরা সিরিয়া এবং ইরাকে দেখতে পাচ্ছি।’ অন্যদিকে সিএনএন’র প্রধান আন্তর্জাতিক নির্বাহী ক্রিস্টিন আমানপৌর হলাঁদের শনিবারের বক্তব্যকে যুদ্ধংদেহী বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ট্রায়াঙ্গাল সেন্টার অন টেরোরিজম অ্যান্ড হোমল্যান্ড সিকিউরিটির পরিচালক ও অধ্যাপক ডেভিড শ্যানঝার বলেন, ‘ইরাক এবং সিরিয়াতে আইএসআইএস’র বিরুদ্ধে ফ্রান্সের লড়াই করা অসম্ভব।’ তাহলে কি আমরা খুব জলদিই সিরিয়া এবং ইরাকের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনীকে দেখতে পাবো?
তবে শ্যানঝার অবশ্য কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করেন। তার ভাষ্য মতে, ‘এধরনের অভিযান মূলত পশ্চিম এবং মুসলিমদের মধ্যে সমস্যা আরও বাড়াবে। আমাদের সেনাবাহিনী এই লড়াইয়ে প্রবেশ করলে একটা গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি ভিন্নদিকে মোড় নিতে পারে। আর তখন উপদ্রুত অঞ্চলগুলোতে সরকার চালানো এবং জাতিগত দাঙ্গা ঠেকানো অসম্ভব হয়ে দাড়াবে ফ্রান্সের জন্য।’
শার্লি হেবদো পরবর্তীতে ফ্রান্সের পদক্ষেপ
ফরাসি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী শার্লি হেবদোর ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন শেরিফ কৌয়াছি এবং সাঈদ কৌয়াচি নামের দুই ভাই। এই দুই ভাইয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে আগে থেকেই জানতো ফ্রান্সের একাধিক নিরাপত্তা সংস্থা। তাদের মধ্যে একজন সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কারণে জেল খেটেছিল এবং সর্বশেষ তিনি সিরিয়াতেও ছিলেন। অন্যজন ইয়েমেনে গিয়েছিলেন প্রশিক্ষনের জন্য। জানুয়ারিতে শার্লি হেবদোর ঘটনার সময় পুলিশের গুলিতে এই দুই ভাই মারা যায়।
ন্যাশনাল সিকিউরিটি বিশ্লেষক পিটার বার্জেন বলেন, ‘কৌয়াছি ভাইদের একজন ইয়েমেনে আলকায়েদার কাছে প্রশিক্ষিত হয়েছিল এবং নিজ দেশের মাটিতে এধরণের আক্রমন চালানোর জন্য যথেষ্ট সময় তারা পেয়েছিল। যদিও তাদের সহায়তাকারী হিসেবে আলকায়েদা জড়িত ছিল। আর এই ঘটনা পরবর্তীতে অবশ্যই ফ্রান্স ইয়েমেনের আলকায়েদার উপর কোনো আক্রমন চালায়নি। কিন্তু সাবেক ঘটনা আর এই ঘটনা এক নয়, বরংচ কিছুটা ভিন্ন। এবং বিষয় হলো, সিরিয়ায় ইতোমধ্যেই যুদ্ধ চলছে যেখানে ফ্রান্স জড়িত আছে। এখন দেখার বিষয় ফ্রান্স কোন ভূমিকা পালন করে।’
আইএসআইএস’র বিরুদ্ধে ফ্রান্সের অতীত লড়াই
শনিবারে অনলাইনে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আইএসআইএস জানিয়েছে যে, তাদের আটজন সশস্ত্র যোদ্ধা বোমার বেল্ট এবং ভারি অস্ত্র নিয়ে ফ্রান্সের রাজধানীতে হামলা চালিয়েছিল। ঘটনাস্থল থেকে একটি সিরিয়ার পাসপোর্টও পাওয়া গিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, নাইন ইলেভেনের হামলার পর জর্জ ডব্লিউ বুশও কিন্তু ওই ঘটনাকে যুদ্ধের সামিল আখ্যা দিয়েছিলেন এবং যার ফলশ্রুতিতে বড় বড় দুটি যুদ্ধ চলছে। সুতরাং মালিতে আলকায়েদার বিরুদ্ধে চালানো ফ্রান্সের আগ্রাসী অভিযান এবং গাদ্দাফিকে উৎখাতে প্রধান ভূমিকাও পালন করেছিল ফ্রান্স। অতীতের সকল ঘটনাতেই ফ্রান্স সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়েছিল। এমনকি গত সেপ্টেম্বরেও প্রথম ফ্রান্সের বিমানবাহিনীই আইএসআইএস’র বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে শুরু করে।
১৯৬০ সালে ফরাসি উপনিবেশ মালির সরকারকে সহায়তা উদ্দেশ্যে ফ্রান্স সেদেশে সশস্ত্র ইসলামিস্টদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল। ইসলামিস্ট জিহাদি আবদেল হামিদ আবু জেইদ ২০১৩ সালে উত্তর মালিতে ফরাসি বাহিনীর হাতে নিহত হয়। আবু জেইদ ছিল আলকায়েদার অন্যতম নেতাদের মধ্যে একজন। ডিসেম্বরে ফ্রান্স বাহিনী উত্তর মালিতে অপর এক উচ্চপদস্থ জিহাদি নেতাকে হত্যা করে। এই নেতার মাথার দাম পাঁচ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিম আফ্রিকাতে পশ্চিমা বিরোধী আন্দোলন এবং সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার কাজ করছিলেন আহমেদ আল তিলেনসি।
বাংলামেইল২৪ডটকম

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়