Monday, November 16

ফেনী আ.লীগ: নিজাম হাজারীই শেষ কথা


ফেনী: বিএনপির দুর্গ হিসেবে খ্যাত এ জেলার তিনটি আসনের এমপিই এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের। মামলা আর গ্রেপ্তারে বিপর‌্যস্ত বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সেখানে একাধিপত্য এখন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের। ভাগবাটোয়ারা আর আধিপত্য নিয়ে তাদের মধ্যে কলহ লেগেই আছে। ফলে ঘটছে খুনোখুনি। ফেনীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিতর্ক ও সমালোচনা নতুন নয়। আগে এই বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন জয়নাল হাজারী। এককালের দাপুটে ও আলোচিত-সমালোচিত জয়নাল হাজারী রাজনৈতিক মাঠে দুর্বল হয়ে পড়লে সেই স্থান দখল করেন (২০০৯) তারই শিষ্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। আর ফেনীবিমুখ হয়ে জয়নাল হাজারী এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে আজিজ আহম্মদ চৌধুরী ও জয়নাল হাজারীর নেতৃত্বাধীন কমিটিকে বাদ দিয়ে আবদুর রহমান বিকমকে সভাপতি ও নিজাম উদ্দিন হাজারীকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরপর নিজাম হাজারী ও তার অনুসারীদের বেশ কিছু কর্মকাণ্ড দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। ২০১৪ সালের ২০ মে ফেনী শহরের একাডেমী সড়কে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একরামুল হক একরামকে। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজাম হাজারীর লোকজনের দিকেই ওঠে অভিযোগের আঙুল। মামলার চার্জশিটের অন্তর্ভুক্ত ৫৮ জনের মধ্যে বিএনপির নেতা মাহতাব উদ্দিন আহমদ চৌধুরী মিনার ছাড়া বাকি সবাই আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। আন্দোলনের মাঠে হামলা-মামলায় প্রতিপক্ষ বিএনপি বিপর্যস্ত; ‘গুরু’ জয়নাল হাজারী নিষ্ক্রিয়, নিজ দল ক্ষমতায়্- ফেনীর রাজনীতিতে এখন নিজাম উদ্দিন হাজারীই শেষ কথা। বিরোধ থেকে খুনোখুনি দলীয় দ্বন্দ্ব আর ‘ভাগবাটোয়ারা’ নিয়ে ফেনী-৩ (দাগনভূঞা-সোনাগাজী) আসনের এমপি জেদ্দা আওয়ামী লীগের সভাপতি রহিম উল্লাহর সঙ্গে নিজাম হাজারীর সম্পর্ক এখন শিথিল। মাঝে মাঝে তা সহিংসতায় রূপ নেয়। সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সামনেই রহিম উল্লাহকে লাঞ্ছিত করেন যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় বেশ কয়েকবার বিবদমান দুটি পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষও ঘটে। তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধে আজিজুল হক ও জসিম উদ্দিন নামের দুই যুবলীগ নেতা খুন হয়। ৭ জুন রহিম উল্লাহর গ্রামের বাড়ি সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে সমাবেশ শেষে ফেনী ফেরার পথে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতাকর্মীকে বিপুল অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। জেলার বিভিন্ন স্থানে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, মাদকের টাকা ভাগবাটোয়ারা ও আধিপত্য-বিরোধের জেরে নিজ দলীয়দের হাতে খুন হন আওয়ামী লীগ-যুবলীগের ছয় নেতাকর্মী। একসময় ফেনীর দলীয় কর্মকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সক্রিয় হলেও দ্বন্দ্ব-কোন্দল আর খুনখারাপির ঘটনায় তিনিও ফেনীবিমুখ হন। অভিযোগ আছে, ইজারা ছাড়াই অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, টেন্ডার, চাঁদাবাজি ও ছিনতাই, মাদক-বাণিজ্যে সম্পৃক্ত রয়েছে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তিন নেতাকে দিয়ে চলছে যুবলীগ ২০০১ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে আজহারুল হক আরজুকে আহ্বায়ক ও শাহজাহান সাজুকে যুগ্ম আহ্বায় করে কমিটি গঠন করা হয়। আরজু-সাজুর নেতৃত্বাধীন কমিটি সদর উপজেলা ছাড়া আর কোনোটিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি। ২০০৮ সালে অ্যাডভোকেট জাকের হোসেন ও একরামুল হক একরাম নেতৃত্বাধীন পৌর কমিটি ভেঙে দিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয় মামুনুর রশিদ মিলনকে। ইউপি নির্বাচনের পর বেশির ভাগ সময় দলীয় কর্মকাণ্ডে অনুপস্থিত তিনি। পৌর শাখার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়াউল আলম মিষ্টার সক্রিয় থাকলেও একরাম হত্যার পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পরে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। প্রায় দশ বছর পর ২০১০ সালে যুবলীগকে ঢেলে সাজাতে চার ছাত্রলীগ নেতা দিদারুল কবির রতনকে আহ্বায়ক, শুসেন চন্দ্র শীল, নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী ও মাঈন উদ্দিন মামুনকে যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাতেও হালে পানি পায়নি। এদের মধ্যে মাঈন উদ্দিন মামুন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হওয়ায় নিজ উপজেলা নিয়েই ব্যস্ত দিদার। জেলা সদরের কর্মসূচিগুলো চলে শুসেন-স্বপনকে দিয়েই। দিদার-শুসেন ও স্বপন নেতৃত্বাধীন কমিটি সংগঠনকে চাঙ্গা করতে সম্মেলনের মাধ্যমে ইতিমধ্যে জেলার ৬ উপজেলা ও ৫ পৌর কমিটি গঠন করেছে। বেপরোয়া ছাত্রলীগ ফেনীতে সাম্প্রতিক সময়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। গুটি কয়েক নেতার অপরাধের লাগাম কোনোভাবেই ধরা যাচ্ছে না। খোদ জেলা পর্যায়ের নেতারাও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় বিব্রত হচ্ছেন শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্রমেই অপরাধের মাত্রা বেড়ে চলেছে। পূর্ববিরোধের জের ধরে গত ৩১ অক্টোবর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের কর্মীদের বিতণ্ডার সময় ছোরা দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয় রবিন নামের এক কর্মীকে। সে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পরদিন ১ নভেম্বর শাহীন একাডেমী স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী রনিকে কুপিয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এলাকাবাসীর অভিযোগ, শাহীন একাডেমী সড়ক, রামপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সড়ক ও তৎসংলগ্ন রামপুর, পুলিশ কোয়ার্টারসহ আশপাশের এলাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যুবলীগের এক নেতার আর্শীবাদপুষ্ট পিটু ও তার সমর্থকরা। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে আসছে এই চক্র। গত কোরবানির ঈদে সদর উপজেলার মোহাম্মদ আলী বাজারে চাঁদা চাইতে গিয়ে লাঞ্ছিত হন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাবেদ হায়দার জর্জ। পরশুরামের এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ব্ল্যাকমেইল করে ৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ সোনাগাজী উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব চৌধুরী রবিনের বিরুদ্ধে। গত ১ অক্টোবর রাতে প্রবাসী কাজী করিম বাদী হয়ে তার স্ত্রী মুক্তার বিরুদ্ধে পরশুরাম মডেল থানায় মামলা করলে বিষয়টি ফাঁস হয়। নিজাম হাজারীই শেষ কথা মূলত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীকে ঘিরেই ফেনীতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের দলীয় কার্যক্রম চলছে। ঈদ কিংবা বিশেষ কোনো উপলক্ষে শহরের সব কটি বিলবোর্ডেই সাঁটানো হয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমদ চৌধুরী নাসিম ও সাংসদ নিজাম হাজারীর ছবিসংবলিত বিশালাকৃতির বিলবোর্ড। একাধিক নেতার দাবি, নিজাম হাজারী দেশের বাইরে গেলে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কিছু নেতাকর্মী বেপরোয়া হয়ে ওঠে, যারা যুবলীগের এক নেতার অনুসারী। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম সালাহউদ্দিন ফিরোজ নেতাকর্মীদের বিব্রতকর কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে বলেন, সব কটি ঘটনা আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিষয়গুলো জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী এমপিও অবগত আছেন। তিনি দেশে ফিরলেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী বলেন, তৃণমূলে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে সুসংগঠিত করতে সব কটি ইউনিটে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে বর্ধিত সভাও চলছে। জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেন, ফেনীতে কোনো দলাদলি নেই। আমরা সবাই একজোট হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কাজ করে যাচ্ছি। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় ফেনীতে বর্তমানে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। আমি প্রতিটি নেতাকর্মীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করি এবং প্রতিটি কর্মীকে আমি বাই নেমে চিনি ও জানি। তিনি বলেন, দলাদলির অভিযোগ ঠিক নয়।আমাদের ফেনীতে কোনো কোন্দলও নেই।দলের নেতাকর্মীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের যে অভিযোগ তা মোটেই ঠিক নয়। সুনির্দিষ্ট অন্তত একটি অভিযোগও যদি আপনাদের কাছে থাকে তাহলে আমাকে বলুন।আসলে সে রকম কোনো অভিযোগ পাবেন না।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়