Tuesday, July 14

‘দেশবাসী পাশে থাকলে আমার পুয়া মারার বিচার হইব’


‘আমরা গরিব মানুষ, আমরারে সাহায্য করেন। দেশবাসী পাশে থাকলে আমার পুয়া (ছেলে) মারার বিচার হইব।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে, শোকে মূহ্যমান পাশবিক অত্যাচারে নিহত কিশোর সামিউল আলম রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান সিলেটি ভাষায় এই আকুতি জানান বাংলামেইলের প্রতিনিধির কাছে। রাজনের ঘটনা সারাদেশে জানাজানি হওয়ার পর সিলেটের সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ রোববার সারাদিন ভীড় জমিয়েছে সিলেট সদরের কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামের বাসায়। লোকজন নানাভাবে তাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। রোববার রাত সাড়ে ১২টায় বাংলামেইলের প্রতিবেদক রাজনের বাড়িতে গিয়ে কথা বলেন রাজনের বাবা আজিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দিন আনি দিন খাই, আমরার কিতা অপরাধ, কিতার লাগি আমার পুয়ারে মারা হইলো? আমার পুয়া কিতা চুর নি? কোনদিন সে চুরি করে নাই। কিন্তু চুরির দোয়াই দিয়াই আমার পুয়ারে মারছে খুনিরা।’ (দিনে এনে দিনে খাই। আমার অপরাধ কি, কেন আমার ছেলেকে মারা হলো? আমার ছেলে কি চোর? কোনোদিন সে চরি করেনি। কিন্তু চুরির দোহাই দিয়ে আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে খুনিরা।) আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমি আমার ছেলের খুনিদের বিচার চাই। যাতে কোনো পিতা-মাতাকে ভবিষ্যতে খুন হওয়া ছেলের লাশ দেখতে না হয়’ বাকরুদ্ধ নিহত রাজনের পিতার জানান, তিনি নগরীর মদিনা মার্কেট এলাকার বাসিন্দা লে. কর্নেল অব. সৈয়দ আলী আহমদের প্রাইভেট একটি মাইক্রোবাসের চালক। অভাবের সংসার হওয়াতে মাইক্রোবাস চালিয়ে যা বেতন-ভাতা পান তা দিয়ে পরিবারে সদস্যদের ভরণ-পোষণ করতে পারতেন না। তাই তিনি বাড়ির পাশে কিছু জমিতে সবজি চাষ করতেন। আর ওই সবজি চাষে তার ছেলে রাজন তাকে সহযোগিতা করতো। আজিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে তিনি নিঃশব্দ হয়ে যান। যেন তার শরীরে কথা বলার মতো কোনো শক্তি নেই। এ সময় তার পাশে থাকা রাজনের ছোট চাচা আল আমিন জানান, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে রাজন। প্রাইমারি স্কুল থেকে ঝরেপড়ার পর থেকে রাজন বাবার সবজি ব্যবসায় সহযোগিতা করে। গত বুধবার সকালে রাজন সবজি বিক্রি করতে নগরীর কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ডে গেলে চোর সন্দেহে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে রাজনকে। এরপর রাজনের মা লুবনা আক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনিও কিছু বলতে চাননি। ছেলেকে হারিয়ে তিনিও বাকরুদ্ধ। তবে তার ছেলের খুনিদের ছবি এবং ছেলেকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে এর কিছু নমুনা সম্বলিত একটি পোস্টার হাতে নিয়ে কাদঁছিলেন তিনি। মা লুবনা কথা না বলেও পরিবারের অন্য সদস্য ও তাদের বাড়িতে আসা আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পর মামলা দিতে গিয়ে তাদের নানা অভিজ্ঞতার কথা। তাদের অভিযোগ, গত বুধবার দুপুরে রাজনের লাশ উদ্ধারের পর রাত ১১টার দিকে জালালাবাদ থানায় একটি মামলা দায়ের করতে গিয়েছিলেন রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান, বড় চাচা শফিকুর রহমান, ছোট চাচা আল আমিন, প্রতিবেশী মো. আলী দুদু মিয়া এবং সামিউলের মামাতো ভাই শেখ আবদুল মালিক। থানায় প্রকৃত নির্যাতনকারী ঘাতকদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার জন্য ওসি (তদন্ত) আলমগীর হোসেন ও এসআই আমিনুল ইসলামকে অনুরোধ করেন তারা। কিন্তু মামলা না নিতে নানা টলবাহানা শুরু করেন পুলিশের ওই দুই কর্মকর্তা। বয়জেষ্ঠ্য মোহাম্মদ আলী দুদু মিয়া বাংলামেইলকে বলেন, ‘তাদের অনুরোধে কান দেননি ওসি (তদন্ত) আলমগীর হোসেন ও এসআই আমিনুল ইসলাম। উল্টো তাদেরকে থানার ডিউটি রুম থেকে বের করে দিয়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে ফোনের মাধ্যমে ‘গোপন’ আঁতাতে ব্যস্ত ছিরেন তারা।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘ওই দুই পুলিশ কর্তকর্তা প্রকৃত খুনিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর দাবির মুখে বাধ্য হয়ে তারা রাজন হত্যা মামলায় প্রকৃত নির্যাতনকারী ঘাতকদের নাম মামলায় অন্তর্ভূক্ত করেছেন।’ এ ব্যাপারে জানতে ওসি (তদন্ত) আলমগীর হোসেন ও এসআই আমিনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। তবে জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আখতার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘রাজনের স্বজনরা যদি লিখিতভাবে অভিযোগ দেন, তবে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ উল্লেখ্য, গত বুধবার সিলেট নগরীর কুমারগাঁওয়ে কিশোর রাজনকে চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। একপর্যায়ে সামিউল মারা গেলে তার লাশ গুম করার সময় পুলিশের হাতে আটক হয় মুহিদ আলম। এ ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে নগরীর জালালাবাদ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে। মামলায় আটক মুহিদ আলম (২২) ও তার ভাই কামরুল ইসলাম (২৪), তাদের সহযোগী আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪) ও চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়নাকে (৪৫) আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত মুহিদের রিমান্ড শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে আজ।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়