Wednesday, July 1

সাবধান! বাজারে ‘নিখুঁত’ জাল নোট


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: বিশেষ ধরনের পুরু কাগজে ছাপা এবং তাতে থাকবে জলছাপ ও নিরাপত্তা সুতা আসল টাকার নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য হিসেবে সাধারণত এসবই লক্ষ্য করে মানুষ। কিন্তু তাতেও এখন আর জাল টাকা চেনার উপায় নেই। দক্ষ কারিগরদের তৈরি নিখুঁত জাল টাকাতেও এসব নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সাধারণভাবে দেখে সেগুলোকে জাল বলে ধরার কোনো সুযোগই নেই। এ কারণে সহজেই বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে প্রচুর জাল নোট। গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় জাল নোট তৈরির প্রায় ৫০টি চক্রের পাঁচ শতাধিক কারিগর সক্রিয় রয়েছে। রমজান ও ঈদ সামনে রেখে বেড়ে গেছে তাদের ব্যস্ততা। এদিকে জাল নোট প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, বিভিন্ন শপিংমলে জাল নোট শনাক্তকারী মেশিনের পাশাপাশি জনসচেতনতা গড়ে তোলার ফলে জাল নোটের বিস্তার আগের তুলনায় কমেছে। এটি আরো কমাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকগুলোকে সচেতনভাবে লেনদেন করতে বলা হয়েছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, জাল নোটের বিস্তার রোধে সবসময়ই সতর্ক রয়েছে র‌্যাব। এরই মধ্যে একটি বড় চক্রকে এক কোটিরও বেশি টাকার জাল নোটসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা বাজারে ৫০ লাখ টাকার জাল নোট ছড়িয়ে দিয়েছে এবং আরও ১০ কোটি টাকার জাল নোট ছড়ানোর পরিকল্পনা ছিল। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, ঈদ বা বড় কোনো উৎসবকে ঘিরে অর্থের লেনদেন বেড়ে যায়। এ সুযোগে তৎপর হয়ে ওঠে জাল নোট ব্যবসায়ীরা। তবে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সক্রিয় রয়েছেন গোয়েন্দারা। এ পর্যন্ত জালনোট ব্যবসায়ীদের অন্তত ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের অনেককেই সাজা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার মাহমুদ নাসের জনি বলেন, জাল নোট তৈরির চক্রগুলোর মধ্যে এখন টাকা নিখুঁত করার ব্যাপারে প্রতিযোগিতা চলে। কারণ যে চক্রের টাকা যত নিখুঁত, তার টাকার দাম তত বেশি, বিক্রিও বেশি। নিখুঁতের মানদণ্ড অনুযায়ী এক লাখ টাকার বান্ডিল ১২ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় ৪৫ থেকে ৫০টি জাল নোট চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি চক্রে ১০ থেকে ১৫ জন করে রয়েছে। তাদের অনেককেই বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেউ কেউ জামিনে বেরিয়ে ফের একই পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। ডিবির এই কর্মকর্তা জানান, জাল টাকা তৈরির প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো বিশেষ ধরনের কাগজ তৈরি। এ ক্ষেত্রে সাধারণ সাদা কাগজের ওপরে স্ক্রিনপ্রিন্টের মাধ্যমে হালকা রঙের ছাপ দেওয়া হয়। এতে কাগজে নকল জলছাপ তৈরি হয় ও কাগজের পুরুত্ব বাড়ে। তার পর টাকার নিরাপত্তা সুতা আঠা দিয়ে কাগজে লাগানো হয়। রূপালি রঙের চকচকে এই সুতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো ও টাকার পরিমাণ লেখা থাকে। এই সুতাও বিশেষভাবে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এক রোল সুতা ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সুতা বসানোর পর পাতলা ট্রেসিং পেপার মূল কাগজের ওপর আঠা দিয়ে লাগানো হয়। এ পর্যায়ে কাগজটিকে আসল টাকার কাগজের মতোই মনে হয়। সাধারণত আলাদা একটি গ্রুপ কাগজ তৈরির কাজ করে। জাল নোট ছাপানোর চক্রগুলো তাদের কাছ থেকে এক বান্ডিল কাগজ পাঁচ হাজার টাকায় কিনে নেয়। নিজস্ব গ্রাফিক্স ডিজাইনারকে দিয়ে তারা ৫০০ ও এক হাজার টাকার ডিজাইন করিয়ে রাখে। জাল টাকার ডিজাইনের ক্ষেত্রে লরেন্স বাবু নামে একজনের রয়েছে বিশেষ সুখ্যাতি। তিনি নিখুঁত ডিজাইন করতে পারেন। কোনো নোটের এপিঠ-ওপিঠের ডিজাইনের জন্য তিনি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেন। এর পর দলনেতার তত্ত্বাবধানে ভাড়া বাসায় ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের সাহায্যে গোপনে চলে টাকা প্রিন্ট করার কাজ। প্রিন্টের জন্য ব্যবহৃত প্রতি সেট কার্টিজ দুই হাজার ৮০০ টাকায় কেনা হয়। এই কালি দিয়ে পাঁচ বান্ডিল (পাঁচ লাখ) টাকা প্রিন্ট করা যায়। র‌্যাব-পুলিশ সূত্র জানায়, জাল নোট ব্যবসায়ী প্রতিটি চক্রের একজন করে দলনেতা থাকে। শীর্ষ দলনেতাদের মধ্যে রয়েছে- ছগীর মাস্টার, কামাল মাস্টার, জাকির, জামান, প্রফেসর সেলিম ওরফে কানা সেলিম, হুমায়ুন, মোস্তফা, সালমা, রুবিনা, রশিদ, মনির, আমজাদ, রহিম বাদশা, ইমন, মাহবুব মোল্লা ও পলাশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত জাল নোট বিষয়ে ১৪৫টি মামলা হয়েছে। এ সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৭টি। এপ্রিল পর্যন্ত জাল নোট বিষয়ে মোট মামলার সংখ্যা পাঁচ হাজার ৯৩৩টি। জাল নোটের কারবারিরা ধরা পড়লেও সাক্ষীর অভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সব পক্ষকে নিয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বলা হয়, ঈদ সামনে রেখে ২২ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট বাজারে ছাড়বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন নোট ছাড়াকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে ওঠে জালকারবারিরা। তা প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া ১০টি উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে আসল নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সংবলিত এক লাখ হ্যান্ডবিল বিতরণ। ১০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকা মূল্যমানের নোট বেশি জাল হয়। এ কারণে হ্যান্ডবিলের পাশাপাশি এসব নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যবিষয়ক পোস্টার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ইউএনও অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের অফিসে নেট দিয়ে আবদ্ধ নোটিশ বোর্ডে টানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এদিকে ঈদ সামনে রেখে বাজারে ছাড়া জাল নোট শনাক্ত করতে বিভিন্ন বিপণিবিতানের ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের জাল নোট শনাক্তকারী যন্ত্র সরবরাহ করেছে এফবিসিসিআই। ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ সংগঠনকে এ কাজে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাজধানীর মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে গতকাল আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এমন ২০০টি জাল নোট শনাক্তকারী যন্ত্র ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবুল কাসেম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এখনকার নীতি হলো, নানা আর্থিক বিষয়ে সচেতন করা। এর অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ ব্যাংক জাল নোট শনাক্তকরণ যন্ত্র ব্যবসায়ীদের দিচ্ছে। অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ জাল টাকা শনাক্তের মাধ্যমে সরবরাহকারীদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন। সমকাল

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়