Friday, June 26

খালেদা জিয়া, ভারত বিরোধিতা এবং নিজেদের স্বার্থ


বাছির জামাল: ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না যাওয়াকেই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ‘বড় ধরনের রাজনৈতিক ভুল’ হিসেবে ধরা হয়। এ নিয়ে তখন পত্রপত্রিকায় বেগম জিয়ার এ সিদ্ধান্তকে বেশ সমালোচনা করা হয়। একটি দেশের রাষ্ট্রপতি সে দেশের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হন। সেই প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করাটা সেই ব্যক্তিকে শুধু নয়, সেই সেদেশের জনগণকেও অপমান করার শামিল। তাই প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়া কেন সাক্ষাৎ করতে গেলেন না, তা অনেক দিন ধরেই জনগণের মধ্যে ধাঁধা হিসেবে থেকে যায়। এর কারণ হিসেবে অনেকে অনেক কথাই অনুমান করেছেন বটে, কিন্তু আসল সত্যটি কেউ বলতে পারেননি এবং খালেদা জিয়ার কাছ থেকে কখনো এ নিয়ে কোনো কৈফিয়তও দেওয়া হয়নি। তবে সম্প্রতি ভারতের দ্য সানডে গার্ডিয়ানের সঙ্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, তার জীবনের ওপর হুমকি ছিল বলেই তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকটি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন। গত ৭ জুন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা পর গুলশান কার্যালয়ে বসে দ্য সানডে গার্ডিয়ানের সাংবাদিক সৌরভ স্যানালকে সাক্ষাৎকারটি দেন খালেদা জিয়া। সানডে গার্ডিয়ান পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক এম জে আকবর। যিনি ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বাতিল হওয়া বৈঠক নিয়ে খালেদা জিয়ার মুখ খোলার পর অনেকেই স্মরণ করছেন ২০১৩ সালের ৪ মার্চ দিনটির কথা। জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যদ-ের রায়কে কেন্দ্র করে তখন রাজপথ ছিল উত্তপ্ত। জামায়াতের ডাকা ৪৮ ঘণ্টা হরতালের সেদিন ছিল দ্বিতীয় দিন। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আসা ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি অবস্থান নেন হোটেল সোনারগাঁওয়ে। এখানেই প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল খালেদা জিয়ার। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে বৈঠকটির সময় নির্ধারিত ছিল। সে সময় বিএনপির পক্ষ থেকে বৈঠক বাতিলের কারণ হিসেবে নিরাপত্তার কথাই বলা হয়েছিল। বৈঠকের নির্ধারিত সময়ের কাছাকাছি সময়ে হোটেল সোনারগাঁওয়ের পাশে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। যে বিস্ফোরণের খবর আবার খুব দ্রুতই প্রচারিত হয় ভারতীয় মিডিয়ায়। সানডে গার্ডিয়ানের সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আমাকে এ প্রশ্নটি করার জন্য আমি খুব খুশি। এটা সত্য কথা যে, আমি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের সময় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিনি। ওই সময় ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তিন শীর্ষ নেতার অভিযোগের বিরুদ্ধে হরতাল আহ্বান করেছিল জামায়াতে ইসলামী। ওই সময় আমি জানতে পারি যে, যদি আমি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই তাহলে আমার ওপর আক্রমণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সেটা হতে পারত প্রাণনাশের হুমকি। রাষ্ট্রপতি যে হোটেলে অবস্থান করছিলেন তার কাছেই একটি পেট্রলবোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। আমার তো ওই পথ দিয়েই যাওয়ার কথা ছিল। যদি ওইদিন আমার কিছু হতো তাহলে পুরো দায় গিয়ে বর্তাতো জামায়াতের ওপর। আমার বিরোধী পক্ষ তো এই গেম খেলার পরিকল্পনা করেছিল। এটা আমরা বুঝতে পারি এবং তারপরই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ওই সাক্ষাৎ বাতিল করি। আজ আপনার সঙ্গে প্রকৃত সত্য ভাগাভাগি করলাম।’ প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠক না করায় বিএনপির ভেতরের এবং এ সংগঠনের প্রতি দুর্বল এমন অনেকে খুশিও হয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য হলো, বিএনপিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে এর ভারতবিরোধী ভাবমূর্তি রক্ষা করতে হবে। তা না হলে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি একেবারে ছিটকে পড়বে। খালেদা জিয়ার ভারত সফরের ব্যাপারে আমার এক সিনিয়র বন্ধু, যিনি এক সময় বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি রীতিমতো কৈফিয়তই তলব করলেন এই বলে যে, ভারতের সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক রেখে এদেশে যে ভারতবিরোধী ভোটব্যাংক রয়েছে, সেই ভোটগুলো কী বিএনপি আর পাবে? সেই দিন তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিয়েছিলাম কি না মনে নেই। তবে তাদের এ সত্যটা কে বুঝাবে যে, শুধু ভারত কেন, কোনো দেশের সঙ্গে স্থায়ী শত্রুতা বজায় রেখে এখন রাজনীতি করা সম্ভব নয়। ভারতের যেসব নীতি বা সিদ্ধান্ত আমাদের বিরুদ্ধে যাবে তার সমালোচনা তো করতেই হবে। তখন তা না করাটা হবে দাসসুলভ মনোভাবের পরিচয়। সম্প্রতি আমাদের দেশের একটি প্রধান ইংরেজি দৈনিক তাদের নিউজ অ্যানালাইসিসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের পর খালেদা জিয়ার বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘বেগম জিয়া আবার তার ভারতবিরোধী পুরনো চেহারায় ফিরে গেছেন।’ গুলশান কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বেগম জিয়া দুই দেশের কানেক্টিভিটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেছেন, ‘কোনো মাশুল ছাড়াই বাংলাদেশের রাস্তা দিয়ে ভারতীয় পরিবহন চলাচল করাটা বন্ধুত্ব হতে পারে না।’ এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের দেশের স্বার্থের পক্ষে কথা বলাটা কিন্তু ভারতবিরোধিতা নয়। আর নেতা-নেত্রীরা যখন কোনো বিষয়ে বিশেষ করে প্রতিবেশী কিংবা বন্ধু দেশ সম্পর্কে কথা বলবেন, তখন তাদের সঠিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কথা বলা উচিত। তা না হলে যে দেশ সম্পর্কে তিনি কথা বলছেন, সেই দেশের সরকার এবং জনগণকে ভুল বার্তা দিতে পারে। basirdhaka@gmail.com

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়