মো. আবুসালেহ সেকেন্দার:
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নেপালের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে মুসলমানদের অবস্থান তৃতীয়। নেপালের মোট জনসংখ্যার ৪.২ ভাগ মুসলমান। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায়ই তাদের বসবাস রয়েছে। তবে দেশটির উত্তরাঞ্চলের চেয়ে দক্ষিণে অধিক মুসলমানের বাস। বাংলা অঞ্চলের শাসকদের মাধ্যমে নেপালে মুসলমানদের আগমনের সূচনা হলেও বর্তমানে নেপালি মুসলমানদের অধিকাংশই কাশ্মীরি, ভারতীয়, তিব্বতীয়, তেরাই ও পাহাড়ি বংশোদ্ভূত।
৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয়ের সূচনা হলেও ১৪ শতকের আগে নেপালে মুসলমানদের আগমন ঘটেছে এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুলতান শামস-উদ-দীন ইলিয়াস শাহের নেপাল আক্রমণের মাধ্যমে নেপালে মুসলিম বসতির সূচনা হয়। যদিও অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, শামস-উদ-দীন ইলিয়াস শাহ নয়, বাংলা বিজেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির সময় নেপালে মুসলিমদের আগমন ঘটে। তাদের মতে, ১৩০০ শতকে বখতিয়ার খলজির তিব্বত অভিযান ব্যর্থ হলে তার সৈন্যদের একটি অংশ দলছুট হয়ে নেপাল গমন করেন এবং পরে তারা সেখানে বসতি স্থাপন করেন। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, সুলতান শামস-উদ-দীন ইলিয়াস শাহের নেপাল জয়ের ফলে নেপালে মুসলিম বসতি স্থাপনের সূচনা হয় এবং পরবর্তীকালে ভারতের মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে তা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়।
সম্রাট আকবরের সময় নেপালে মুসলিম বসতি স্থাপনের প্রসার ঘটলেও তিনি গুর্খাদের সঙ্গে বিরোধে জড়াতে ইচ্ছুক ছিলেন না বলে নেপালকে তার সাম্রাজ্যভুক্ত করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। পরবর্তী সময়ে ধারবাহিকভাবে নেপালে মুসলিম জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০১ সালের জরিপ অনুসারে নেপালে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ১৯৭ জন মুসলমান বসবাস করে। ওইসব মুসলমানের শিক্ষা গ্রহণের জন্য নেপালে প্রায় ৩০০ মাদরাসাও গড়ে উঠেছে। ধর্মচর্চার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৩৪৩টি মসজিদ।
মাহে রমজানে নেপালে মুসলমানরা একত্রে তারাবির নামাজ আদায় করেন। বাংলাদেশের মতো মসজিদগুলোয় ইফতারেরও আয়োজন করা হয়। রমজান মাসে একজন নেপালি মুসলমান সাহরি খাওয়ার আগে মিসওয়াক করার মাধ্যমে সাহরি খাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন। বিভিন্ন মাদরাসার বোর্ডিংয়ে থেকে শিক্ষার্থীরা সাহরির সময় দল বেঁধে মিসওয়াক করেন। নেপালের অধিকাংশ মুসলমান ফলমূল, শাকসবজির দ্বারা তৈরি খাবার আর মিষ্টি খেয়ে রোজা ভাঙেন। যেসব নেপালি মুসলমান ধূমপানে অভ্যস্ত তারা এ মাসে সাধারণত ধূমপান থেকে বিরত থাকেন। বর্তমানে নেপালে অনেক বাংলাদেশী বসবাস করায় নেপালের মুসলিম সংস্কৃতিতে সাহরি ও ইফতারের রীতি-নীতিতে বাংলাদেশী সংস্কৃতির প্রভাব বেশ লক্ষণীয়।
নেপালের মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারভিত্তিক বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন মাহে রমজানে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। কাঠমান্ডুর আল মারকাজুল ইসলামী, কাঠমান্ডু ও গুর্খার জুমা মসজিদ, মাদরাসা মাজহারুল উলুম ও বুটিয়ালের মদিনা মসজিদ মাদরাসায় মাহে রমজানে ইফতারের বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া মাহে রমজান উপলক্ষে মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো নানা সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব সেবা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে কপিলাবস্তুর আল ফালাহ দাতব্য সংস্থা, জানাকপুরের ইসলামিক ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, সানসুরির মিল্লাত ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, কাঠমান্ডুর মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন, বীরগঞ্জের নেপাল মুসলিম রিলিফ সোসাইটি অন্যতম। সম্প্রতি নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ায় অনেক মুসলমানই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে ভূমিকম্প বিধস্ত নেপালি মুসলমানরা নানা সঙ্কটে দিন অতিবাহিত করলেও মাহে রমজান এ বছরও নেপালি মুসলমানদের ঘরে ঘরে উৎসবের বারতা নিয়ে এসেছে।
খবর বিভাগঃ
ইসলাম
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়