Saturday, June 6

রমজানের প্রস্তুতি ভাবনা


মাওলানা মুহাঃ সিরাজুম মুনীর তাওহীদ: মধ্য শাবানের পুণ্যময় রজনী গত হয়ে গেল। এ মাসের আর মাত্র কয়েকটি দিন বাকি আছে। এর পরই আসছে পুণ্যের পসরা নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান। সে যেন এক মেহমান। তার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি মোমিন হৃদয় অনাবিল আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওঠে। সে আসে রহমত নিয়ে, মাগফিরাত নিয়ে, মুক্তির বারতা নিয়ে। তার আগমনে খুলে যায় পুণ্য ও কল্যাণের প্রতিটি বদ্ধ দ্বার, রুদ্ধ হয় অকল্যাণ ও অপশক্তির প্রতিটি খোলা দুয়ার। আনন্দে মাতোয়ারা হয় আসমানের নূরানি ফেরেশতা, জমিনের করুণাভিখারি খোদার বান্দা, আলমে বরজাখের কবরবাসী। তাই তো তার আগমনের অপেক্ষায় আজ গোটা মুসলিম বিশ্ব অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। বছরের ১১ মাস ধরে যে মেহমান বরণ করার জন্য খোদায়ি নির্দেশে জান্নাতকে তিলে তিলে সাজানো হয়েছে কখন আসবে সে মেহমান, কখন হাসবে তার আগমনের বারতা নিয়ে আসমানের নীল সামিয়ানা ভেদ করে সোনালি বাঁকা চাঁদ। যে মেহমানের আগমনের আগেই বিশ্বনবী রাসুলে আরাবি (সা.) উম্মতকে তার পরিচয় দিতেন এভাবে- ‘হে লোক সবাই, তোমাদের সামনে আগমন করছে বরকতময় এক মহান মাস। যে মাসে একটি বিশেষ রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এ মাস ধৈর্যের মাস, সহমর্মিতার মাস, রিজিক বৃদ্ধির মাস। এ মাসের প্রথম অংশ রহমতের, দ্বিতীয় অংশ মাগফিরাতের আর শেষাংশ জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য।’ রাসুলে পাক (সা.) নিজে যেমন এ মাসকে বরণ করার জন্য আগে থেকেই পূর্ণ প্রস্তুতি নিতেন, তেননি সাহাবায়ে কেরামকেও এজন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। এ মাস মহিমান্বিত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছিল অমোঘ ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনুল কারিম। এ মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সিয়াম সাধনা, রাতের সালাতুত তারাবি এবং বরকতময় সেহরি ও ইফতার। এ মাস বরণ করার অর্থ এই নয় যে, আমরা তাকে শুধু মুখেই বলব ‘খোশ আমদেদ মাহে রমজান, স্বাগতম মাহে রমজান।’ এ মাস বরণ করার অর্থ হলো, এ মাসে আল্লাহ তায়ালা যত মহিমা ও নেয়ামত বান্দাকে দেয়ার ওয়াদা করেছেন তা সবই যথার্থভাবে গ্রহণ করা। আর তা গ্রহণ করার জন্য নিজেকে তার যোগ্য পাত্র করতে হবে, মানসিকভাবে নিতে হবে প্রস্তুতি। আর প্রাত্যহিক রুটিনকেও সাজাতে হবে সেভাবে। এ মহিমাময় মাসটিও যেন বাকি ১১ মাসের মতো দুনিয়াবি ব্যস্ততা আর অবহেলা-অনাদরে কেটে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ইসলামের মহান ইমামদের জীবনচক্র আমাদের মতো দুনিয়াবি ব্যস্ততা আর অর্থহীন কাজের মাধ্যমে কাটত না। ইলম ও ইবাদাতের সাধনায়ই ব্যয় হতো তাদের রাত-দিন। তার পরও এ মহান মাসের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে বরণ করার বাড়তি প্রস্তুতি নিতেন তারা। ইমাম শাফেঈ (রহ.) তো রমজান আসার সঙ্গে সঙ্গে ফিকহের সব কিতাব গুছিয়ে রেখে শুধু কোরআন অধ্যয়নে নিবিষ্ট হতেন। বলা হয়, প্রতি রাতে তিনি কোরআন খতম করতেন। কিন্তু রমজানকে বরণ করার জন্য আমাদের প্রস্তুতির হালচিত্র কেমন? কেউ এ মাসকে গ্রহণ করে হীন ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার মাধ্যম হিসেবে। এ মাসকে কাজে লাগিয়ে তারা খাদ্যে ভেজাল আর অগ্নিমূল্যে পণ্য বিক্রি করে বিপুল মুনাফা হাতিয়ে নেয়। কেউবা আবার বন্দি ইবলিস শয়তানের প্রতিনিধিত্বে মেতে ওঠে। আর যারাও বা রোজা রাখেন তারাও রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ভুলে গিয়ে মাসব্যাপী ভূরিভোজের জন্য রমজানের আগে থেকেই বাসায় হরেক রকমের খাদ্যসামগ্রীর স্তূপ জমাতে থাকেন। এটা রমজান মাসের সঙ্গে এক ধরনের পরিহাসই বলা চলে। তাই প্রকৃত মুসলমান হিসেবে আমাদের আজ গভীরভাবে ভাবতে হবে। রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল অথচ নিজের গোনাহখাতা মাফ করিয়ে নিতে পারল না তার প্রতি আল্লাহর লানত।’ রমজান সামনে নিয়ে আজকে আত্মজিজ্ঞাসা করতে হবে, আমরা কি পেরেছি বিগত রমজানগুলোতে নিজেদের মার্জনা করিয়ে নিতে? রমজানের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কি হতে পেরেছি সদ্যজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ? যদি সন্তোষজনক জবাব না আসে তাহলে আগত রমজানকে নিয়ে নতুন করে ভাবুন। এটিকে গনিমত মনে করুন। গত রমজানে যাদের নিয়ে রোজা রেখেছেন, সেহরি, তারাবি ও ঈদ করেছেন তাদের অনেকের জন্য সেটিই ছিল জীবনের শেষ রমজান। আজ তারা কবরের অধিবাসী। আপনাকে যে আল্লাহ তাদের কাতারে শামিল করেননি, এটিকে মহা সুযোগ মনে করুন। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হোন আগত রমজানের প্রতিটি সেকেন্ড ও মিনিটকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করার জন্য। আগে থেকেই প্রস্তুতি নিন, সাজিয়ে রাখুন রমজানে আপনার কর্মপরিকল্পনা। প্রস্তুতি হিসেবে নিচের বিষয়গুলো সামনে রাখুন। ১. রমজান আসার আগে থেকেই আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনো বাক্যে দোয়া করুন, যেন আল্লাহ তায়ালা আমাদের রমজানে সুস্থতার সঙ্গে রোজা রেখে তার হক যথাযথভাবে আদায় করার তৌফিক দেন। রাসুলে পাক (সা.) এভাবে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দাও এবং রমজান মাসে উপনীত করো।’ ২. রোজা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় মাসয়ালা-মাসায়েল নির্ভরযোগ্য আলেম ওলামাদের মাধ্যমে ও কিতাবাদি দেখে রপ্ত করে নিন। রমজানের আগে রমজান সংশ্লিষ্ট মাসয়ালা-মাসায়েল নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। ৩. রমজানে পালনীয় ইবাদত-বন্দেগিতে বাধা হতে পারে এমন বড় কাজ রমজানের আগেই সমাধান করে রমজানের পূর্ণ সময়টাকে ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানোর জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন। ৪. রাসুলে পাক (সা.) সব সময়ই দানশীল ছিলেন। কিন্তু রমজান এলে তার দানশীলতা আগের চেয়ে বেড়ে যেত। তাই আমাদেরও এ মাসে বেশি বেশি দান-সদকা করা উচিত। আর এজন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত। ৫. আগের বছরের কোনো রোজার কাজা থেকে থাকলে রমজান আসার আগেই তা আদায় করে নিন। ৬. কোথায় তারাবি নামাজ পড়বেন তা আগেই নির্ধারণ করে রাখুন। আগে থেকেই খতম তারাবির জন্য হাফেজ নির্বাচন ও নির্ধারণ করে রাখতে হবে। ৭. যে অনাবিল রহমত ও বেহেশতি সওগাত নিয়ে রমজান আসছে তার জন্য মনের সঙ্গে ঘরের পরিবেশকেও সুন্দর করে সাজান। মূর্তি বা প্রাণীর ছবি টানানো থাকলে সেটা সরিয়ে কোরআনের আয়াত দিয়ে ঘরটিকে সাজিয়ে তুলুন। বাহ্যিক অবয়বে আপনাকে বিজাতির মতো দেখা গেলে অন্তত এ মাসটিতে নিজেকে পাল্টে ফেলুন, যা পরিবর্তনের সাধ্য আপনার আছে তা পরিবর্তন করলে যা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে সে অন্তরকেও আল্লাহ তায়ালা পরিবর্তন করে দেবেন, এমনটি আশা করা যায়। ৮. নেক কাজের নিয়ত করার সঙ্গে সঙ্গেই সওয়াব শুরু হয়ে যায়। পরে কোনো কারণে কাজটি না করতে পারলেও তার পূর্ণ সওয়াব আমলনামায় লেখা হয়। তাই রমজানে কোন কোন কাজ করবেন তার নিয়ত আগেই করে ফেলুন। ৯. বিগত রমজান নিয়ে মোহাসাবা বা পর্যালোচনা করুন। সেখানে আপনি যা করেননি অথচ করা উচিত ছিল অথবা আপনি করেছেন অথচ করা উচিত ছিল না- দুইটিরই একটি তালিকা তৈরি করে ফেলুন। আর তার আলোকেই আগত রমজানের কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করুন। ১০. রমজানের সম্মানে আপনার নিত্যদিনের বদ অভ্যাসগুলো থেকে অন্তত একটি বদ অভ্যাস দূর করে ফেলুন। এ জন্য চাই আল্লাহর সাহায্য ও মনের দৃঢ়তা। আর এর চর্চা শুরু হয়ে যাক রমজান আসার আগ থেকেই। লেখক : মুহাদ্দিস, ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত কামিল মাদরাসা

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়