Saturday, June 20

প্রয়োজন সুদমুক্ত অর্থনীতি


এ কিউ এম ছফিউল্লাহ আরিফ: ইসলাম সর্বজনীন ও সৃষ্টি জগতের শান্তি-সমৃদ্ধির অনুপম আদর্শ। যে আদর্শে সৃষ্টির সেরা আদম সন্তানের সর্বময় কল্যাণ নিহিত। ইসলাম সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক ও যাবতীয় সমস্যার সমাধান প্রদানকারী। ইসলাম সর্বকালের সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ আসনের আলোকবর্তিকা। জীবনের সব ক্ষেত্রে সহজ ও প্রাকৃতিক সমাধানদাতা। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘ত্বাহা। তুমি ক্লেশ পাবে এজন্য আমি তোমার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করিনি।’ (সূরা ত্বাহা : ১-২)। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ডিজিটাল এ যুগে ইসলামের দিকনির্দেশনা ও সমাধানে অসামান্য আদর্শ হিসেবে বিশ^ব্যাপী সমাদৃত। ব্যাংকিং জগতে ইসলামী নীতিমালা পবিত্র কোরআন ও মহানবী (সা.) এর অনুপম জীবনালেখ্য তথা হাদিস থেকে উৎসারিত। পবিত্র কোরআন যেমন নির্ভুল ও অভ্রান্ত, তেমনি ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং নীতিমালাও অভ্রান্ত এবং প্রশ্নাতীত। ইসলামের নীতিমালা শাশ^ত ও চিরন্তন। এ বিষয়ে বিন্দু-বিসর্গমাত্র সংশয়-সন্দেহ পোষণ অথবা এ বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করা ঈমানবিরোধী কাজ। বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যে তত্ত্ব গৃহীত হয়েছে তা কোনো দুর্ভাগ্য নয়; বরং আশীর্বাদ। কারণ, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই ইসলাম আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত জীবনাদর্শ।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৯)। সুতরাং যে অর্থব্যবস্থা সমাজে শোষণ, বঞ্চনা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের প্রাচীর গড়ে তোলে, সে মানবপ্রসূত অর্থব্যবস্থাকে ইসলামের সুমহান নীতি এবং ইনসাফভিত্তিক, কল্যাণকর ও মানবতার অর্থ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করা সময়ের দাবি। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার অন্যতম নীতি হলো- সম্পদের একচ্ছত্র মালিকানা আল্লাহর। মানুষ ভোগের অনুমোদিত অধিকারী মাত্র। সুতরাং তা ভোগ করা এবং লেনদেন করার প্রক্রিয়াও হতে হবে মূল মালিকের দেখানো পথে। তাই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা প্রতারণা, শোষণ ও সুদমুক্ত। ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মানদন্ড হলো হালাল উপায়ে ব্যবসা পরিচালনা এবং সুদমুক্ত-শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ। ইসলাম সুদের বিষয়ে সর্বোচ্চ কঠোরতা আরোপ করেছে। রিবা ও সুদের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য ছাড়া মূলত কোনো পার্থক্য নেই। ‘রিবা’ আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ অতিরিক্ত গ্রহণ। আর সুদ এসেছে ফার্সি ভাষা থেকে। সুদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কুল্লু ক্বরদিন র্জারা নাফ’আন ফাহুওয়া রিবা।’ অর্থাৎ যে ঋণ বা লোনের বিনিময় কোনো অতিরিক্ত মুনাফা এনে দেয় তাই রিবা বা সুদ। সুদের সংজ্ঞায় ‘তাফসিরে তাবারি’র তৃতীয় খন্ডে বলা হয়েছে- ‘রিবা হচ্ছে সেই বাড়তি অর্থ যার বিনিময়ে ঋণদাতা ঋণ পরিশোধের সময়টা আরও কিছু দিনের জন্য বাড়িয়ে দেয়।’ অর্থাৎ ঋণ প্রদান করে সময়ের হিসেবে গৃহীত অতিরিক্ত কিছু গ্রহণই হলো সুদ, যার মূলমন্ত্র হলো- Time is Money। এর সঙ্গে কোনো পণ্য বা দ্রব্যের লেনদেন নিষ্প্রয়োজন। ‘যেন টাকাই টাকা জন্ম দেয়।’ প্রচলিত ব্যাংকগুলো সে প্র্যাকটিসই করে- যা কোনো সুস্থ বিবেক মেনে নিতে পারে না। রিবা বা সুদ মূলত ঋণসংশ্লিষ্ট একটি বিষয়। তবে পণ্য লেনদেনের ক্ষেত্রেও সুদ হতে পারে, যা ‘রিবা ফদল’ নামে পরিচিত। ইবনুল আরাবি ‘আহকামুল কোরআন’-এর প্রথম খন্ডে বলেছেন- ‘রিবা হচ্ছে সে বাড়তি দাম, যা কোনো মালের বিনিময় নয়।’ এ রিবা স্বনামে হোক, বেনামে হোক বা অন্য যে কোনো নামেই হোক না কেন, তা সরলভাবেই হারাম। সূরা বাকারার শেষের দিকের আয়াতগুলোতে নিহিত ভীতি প্রদর্শনের ভয়াবহতা ও শাস্তিদানের হুমকির তীব্রতায় মুসলিম হৃদয় উৎকণ্ঠিত হয়। আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন- “যারা সুদ খায় তারা দাঁড়াবে ওই ব্যক্তির মতো যাকে শয়তান স্পর্শ করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। এ অবস্থা তাদের এ জন্য যে, তারা বলে ‘বেচাকেনা তো সুদেরই মতো।’ অথচ আল্লাহ বেচাকেনাকে বৈধ করেছেন আর সুদকে করেছেন অবৈধ। যার কাছে তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই এবং তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যারা পুনরায় সুদ নেবে, তারাই অগ্নির অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না। যারা ঈমান আনে, সৎ কাজ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়, তাদের পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। হে মোমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মোমিন হও। আর যদি তোমরা না ছাড় তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে যুদ্ধের (প্রস্তুত হয়ে) ঘোষণা দাও; কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর তবে তোমাদের মূলধন থেকে যাবে। তোমরা অত্যাচার করবে না এবং অত্যাচারিতও হবে না।” (আল কোরআন-২ : ২৭৫-২৭৯)। উল্লেখ্য, সুদ শুধু ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ নয়; বরং তা সব ধর্মে ঘৃণিত ও নিষিদ্ধ একটি বিষয়। সর্বপ্রথম সুদ নামক এই প্রক্রিয়া বনি ইসরাইলই (ইহুদি) উদ্ভাবন করে। সুদি ‘মহাজনি’ প্রথা তাদের সমাজেই প্রথম চালু হয়েছে। ইহুদি ধর্মে সুদ নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তারা এ জঘন্য কাজটি করত বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে। ইহুদিরা ‘রিবা’ অর্থ করেছে ‘ইউজারি’, যা চক্রবৃদ্ধি হারে চড়া সুদকে বোঝায়। আর ‘সুদ’ বলতে চক্রবৃদ্ধিহীন ‘ইন্টারেস্ট’ (Interest) তথা সাধারণ সুদকে বোঝায়। তারা ‘ইউজারি’ এবং ‘ইন্টারেস্ট’কে আলাদা করেছে। ইহুদিদের মতে, রিবা নিষিদ্ধ; কিন্তু বর্তমানে যে সুদ সমাজে এবং প্রচলিত ব্যাংকগুলোতে চালু আছে তা নিষিদ্ধ নয়। এভাবে সুদের দুই ধরনের ধারণা ইহুদিদের মাথা থেকেই এসেছে। শুধু আজ নয়; মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এর সময়েও তারা এমন বক্তব্য উপস্থাপন করে বলেছিল- ‘নিশ্চয়ই ব্যবসা তো সুদের মতোই।’ প্রায় দেড় হাজার বছর পর আমরা কেউ কেউ যেন আবার সেই চিন্তাধারার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি। মূলত ইহুদিরা সুদও খেতে চায় আবার ধার্মিকও থাকতে চায়। তারা ধর্মের অনুশাসন মেনে চলে এটা প্রমাণের জন্য ‘ইউজারি’ বৈধ বলে না; কিন্তু ‘ইন্টারেস্ট’কে বৈধ বলে গ্রহণ করে শুধু নিজেদের স্বার্থে। তাই সুদের দুই ধরনের অর্থের জন্ম দিয়েছে। আজও যারা প্রকাশ্য সুদের সঙ্গে জড়িত সেই তারাই হাল্কা সুদ (কথিত মানবিক) আর কড়া সুদের (রিবা) তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে। ইসলাম বলছে, যা হারাম তা বেশি পরিমাণে যেমন হারাম, পরিমাণ কম হলেও তা হারাম। সুতরাং সুদ চক্রবৃদ্ধি হোক বা না হোক তা হারামই। পবিত্র কোরআনে সুদ, ইন্টারেস্ট কিংবা ইউজারি সামগ্রিক অর্থে শুধু আরবি ‘রিবা’ শব্দেরই ব্যবহার হয়েছে। বৈধ কোনো সুদের স্বীকৃতি অন্য কোনো আরবি শব্দে হয়নি। সুদের বাইরে যা বৈধ করা হয়েছে তা হলো ‘বাই’ (ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা)। আর এ কথা সর্বজনবিদিত যে, শুধু অর্থ দিয়ে ব্যবসা হয় না। অর্থ, মেধা, শ্রম, পণ্যদ্রব্য এসবের সমন্বিত বিনিয়োগই হলো ব্যবসা। যাতে লাভ-ক্ষতি উভয়ের সম্ভাবনা থাকে। আর সুদ হলো সুনিশ্চিত লাভের ‘ওয়ানওয়ে’ ফর্মুলা, যা মানুষের জন্য অনাকাক্সিক্ষত এক অভিশাপ। এ যুগের শ্রেষ্ঠ ইসলামী অর্থনীতিবিদ ডক্টর ইউসুফ আল কারাদাভী তার ‘প্রচলিত ব্যাংকের সুদও হারাম সুদ’ শীর্ষক বইয়ে বলেন, ‘ইসলাম কোরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট অকাট্য দলিল দ্বারা সুদকে হারাম করেছে এবং এটা নিষিদ্ধকরণে অতি কঠোরতা দেখিয়েছে। এতে কোনো চিন্তাবিদের চিন্তা কিংবা নবায়ন ও ইজতিহাদের সমর্থকের মন্তব্যের কোনো স্থান নেই। কারণ, যে বিষয়টি অকাট্য প্রমাণাদি দ্বারা সাব্যস্ত হয় তাতে ইজতিহাদ চলে না।’ (পৃষ্ঠা নং-৮)।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়