Thursday, June 4

শুক্রবার ফজরে বিশেষ কেরাত


মাওলানা আহমাদ উল্লাহ: মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) শুক্রবার ফজরের নামাজের প্রথম রাকাতে নিয়মিত সূরা আলিফ লাম মিম সিজদা ও দ্বিতীয় রাকাতে সূরা দাহার তেলাওয়াত করতেন। আমাদের দেশে অল্পসংখ্যক মসজিদে হলেও এ সুন্নতটি পালন করা হয়। যদিও সৌদি আরবের মসজিদগুলো বিশেষ করে, মক্কা ও মদিনার হারামাইন শরিফে নিয়মিত এ সুন্নত পালন করা হয়। যে কোনো ফরজ নামাজে পাঠ্য স্ন্নুত কেরাতের চেয়ে শুক্রবার ফজরের নামাজের এ কেরাত আয়তনে সবচেয়ে বৃহৎ। স্বাভাবিকভাবে উভয় সূরা পাঠ করলে দুই রাকাত নামাজে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় লাগে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এর প্রতিটি কাজেরই কোনো না কোনো অন্তর্নিহিত তাৎপর্য থাকে। শুক্রবার ফজরের নামাজে নিয়মিতভাবে এ দীর্ঘ কেরাত পাঠেরও তাই বিশেষ তাৎপর্য আছে। সূরা দুইটি নিয়ে গবেষণা করলেই তা প্রতিভাত হয়ে ওঠে। উভয় সূরায় মানব জীবনের আদ্যোপান্ত বিবৃত হয়েছে অত্যন্ত চমৎকারভাবে। মানব জাতির সৃষ্টিবৃত্তান্ত থেকে নিয়ে জীবনের নানা দিক এবং আখেরাতের পথে যাত্রা ও চূড়ান্ত গন্তব্য প্রসঙ্গে বিষদভাবে আলোচিত হয়েছে উভয় সূরায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি শুক্রবার ভোরে ফজরের নামাজে উপরোক্ত সূরা দুইটি তেলাওয়াত করে মানুষকে তার জীবনের বাস্তবতা, বৃত্তান্ত ও চূড়ান্ত গন্তব্য সম্পর্কে ধারণা দিতে চাইতেন। যেন সপ্তাহজুড়ে তা মনে পড়ে বারবার এবং সৎপথে চলতে তাকে সাহায্য করে। সূরাদ্বয়ের আলোচ্য বিষয় ১. মানব জাতির সৃষ্টির তত্ত্ব : সূরা আলিফ লাম মিম সিজদার শুরুতেই আল্লাহ তায়ালা মানব সৃষ্টির তত্ত্ব নিয়ে আলোকপাত করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘যে জিনিসই তিনি সৃষ্টি করেছেন উত্তমরূপে সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি থেকে, তারপর তার বংশ উৎপাদন করেছেন এমন সূত্র থেকে, যা তুচ্ছ পানির মতো। তারপর তাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করেছেন এবং তার মধ্যে নিজের রুহ ফুঁকে দিয়েছেন, আর তোমাদের কান, চোখ ও হৃদয় দিয়েছেন, তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (আয়াত : ৭-৯)। সূরা দাহারের শুরুতেও একই প্রসঙ্গ টেনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের ওপরে কি অন্তহীন মহাকালের এমন একটি সময়ও অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযোগ্য কোনো জিনিসই ছিল না? আমি মানুষকে এক সংমিশ্রিত বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছি যাতে তার পরীক্ষা নিতে পারি। এ উদ্দেশ্যে আমি তাকে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী করেছি।’ (আয়াত : ১-২)। ২. মানুষের যাপিত জীবনে চলার পথ ও পদ্ধতি : সূরা আলিফ লাম মিম সিজদায় মানব জাতির সৃষ্টি তত্ত্ব আলোচনার পর জীবনযাপনের পথ ও পদ্ধতির আলোকে মানুষকে দুইটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে সেসব লোকের কথা যারা ঈমানদার, সৎকর্মশীল, আল্লাহর শুকরগুজার ও তার প্রতি বিনয়ে অবনত হয়ে সিজদা করে থাকেন। প্রসঙ্গত, সেই শ্রেণীর লোকদের কর্ম (সিজদা ও বিনয়ের) দৃষ্টান্তস্বরূপ তাৎক্ষণিক একটি প্রতীকী সিজদার আয়াতও রয়েছে এ সূরায়। যা হোক, তারা রাত জেগে দাঁড়িয়ে ইবাদত-বন্দেগি পালন করে থাকেন এবং আল্লাহর রাহে ব্যয় করেন। এরপর অপর শ্রেণীর মানুষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা তাদের জীবন ব্যয় করে আল্লাহর প্রতি অবাধ্য ও অবিশ্বাসী হয়ে, নিজের ও অন্যের প্রতি অবিচারে নিজেকে নিয়োজিত করে রাখে তারা। সূরা দাহারেও একইভাবে শুরুতে মানব সৃষ্টির আলোচনার পর কর্মপদ্ধতির আলোকে মানুষের প্রকারভেদ আলোচনা করা হয়েছে। যথারীতি শুরুতে শুকরগুজার, নেককার, ইবাদতকারী, আল্লাহর ভয় লালনকারী এবং কোনো ধরনের বিনিময় এমনকি স্বীকৃতিরও আশা না করে শুধু আল্লাহপ্রেমে তাড়িত হয়ে অভাবী ও বিপদগ্রস্তদের খাদ্য দানকারী লোকদের কথা উঠে এসেছে। এরপর রয়েছে অবিশ্বাসী কাফের ও জালেমদের আলোচনা। ৩. মানুষের মৃত্যু পরবর্তী গন্তব্য : এখানে একটা বিষয় বেশ মজার ও লক্ষণীয়, সূরা আলিফ লাম মিম সিজদায় মোমিনের ঈমানি জীবনের গন্তব্য সম্পর্কে খুবই সংক্ষেপে আলোকপাত করা হয়েছে। অথচ সূরা দাহারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত ও সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সে সূরায় জান্নাতের নেয়ামতগুলো সম্পর্কে সূক্ষ্ম কিছু বর্ণনা রয়েছে। এর বিপরীতে কাফেরদের সম্পর্কে সূরা আলিফ লাম মিম সিজদায় বিষদভাবে বর্ণিত হলেও সূরা দাহারে বর্ণিত হয়েছে সংক্ষিপ্ত আকারে। অর্থাৎ প্রথম রাকাতে কুফুরি ও অবাধ্যতার পরিণতির বিষয়ে বিষদভাবে সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় রাকাতে ঈমানদারের জন্য ঘোষিত পুরস্কার ও সুসংবাদের আলোচনা করা হয়েছে সবিস্তারে। যেন তা শুনে ঈমানদার সিজদাকারী ব্যক্তির অন্তর প্রশান্ত ও পুলকিত হয়। কেমন যেন মহান আল্লাহ মানুষকে সম্বোধন করে বলছেন, হে আমার সম্মুখে সিজদারত! প্রথম রাকাতে বর্ণিত অবাধ্যদের পরিণতি শুনে তুমি হয়তো অনেক বেশি সন্ত্রস্ত হয়ে আছ। তোমার মাথা উঠাও এবং তোমার মতো ঈমানদার ও নেক আমলকারীর জন্য কী কী জান্নাতি নেয়ামত রেখেছি তা শোন। প্রথম রাকাতের শেষের দিকে তাই এরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর কেউ জানে না তাদের কাজের পুরস্কার হিসেবে তাদের চোখের শীতলতার কী কী সরঞ্জাম সুপ্ত রাখা হয়েছে।’ (আয়াত : ১৭)। তারপর এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে সুরা দাহারে, যা আল্লাহর রাসুল (সা.) দ্বিতীয় রাকাতে পড়তেন। উদ্দেশ্য হলো সিজদারত বান্দাকে জানিয়ে দেয়া যে, ঈমান ও নেক আমলের বদলাস্বরূপ আল্লাহ তায়ালা তার সম্মানে কী কী উপঢৌকন রেখেছেন। আর এভাবেই যেন মানুষ নিজের অস্তিত্বের নেয়ামত জেনে আল্লাহর অবাধ্য হওয়া থেকে বিরত থেকে পরম অনুগত বান্দা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে, সে মর্মে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর রাসুলের প্রতি শান্তির বারিধারা বর্ষণ করুন, ঈমানদারদের প্রতি কতখানি দয়াময় ছিলেন তিনি! সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ দিনটির যে সময়ে মানুষের মন ও মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ ফ্রেশ থাকে, ঠিক সেই মায়াস্নিগ্ধ প্রভাতে তিনি তাদের জন্য সারা সপ্তাহের ঈমানি চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা করতেন! আল্লাহুম্মা সাল্লি আলাইহি আল্লাহুম্মা বারিক আলাইহি।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়