Friday, June 12

রমজানকে স্বাগত জানিয়ে মহানবী (সা.) এর ভাষণ


হাসানুল কাদির: রমজান মাসের মাহাত্ম্য, তাৎপর্য, গুরুত্ব ও শিক্ষা বিষয়ে রাসুল (সা.) বহুভাবে অসংখ্য হাদিসে আলোকপাত করেছেন। হজরত সালমান ফারসি (রা.) এর সূত্রে বায়হাকি, তারগিব ও তারহিবে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। শাবানের শেষ তারিখে সাহাবায়ে কেরামের এক জমায়েতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়ে প্রদত্ত ওই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘লোকসব, একটি সম্মানিত ও কল্যাণময় মাস তোমাদের সামনে হাজির হয়েছে। এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসে প্রতিদিন রোজা রাখা তোমাদের ওপর ফরজ। রাতের বেলায় ইবাদত-বন্দেগি করা নফল সাব্যস্ত করেছেন। এ মাসে যে কেউ একটি নফল কাজ সম্পাদন করবেন, সে অন্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব পাবেন। যে এ মাসে একটি ফরজ দায়িত্ব সম্পাদন করবেন, সে অন্য মাসের ৭০টি ফরজের সমপরিমাণ সওয়াব পাবেন। এটি সবর প্রশিক্ষণের মাস। আর সবরের বিনিময় জান্নাত। এটি পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা চর্চার মাস। এ মাসে মোমিন বান্দাদের রিজিক বাড়িয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবেন, তা তার জন্য গোনাহ মাফ এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের অন্যতম কারণ বলে গণ্য হবে। তাছাড়া সেও রোজাদারের সমান সওয়াব পাবেন; অথচ এ কারণে সংশ্লিষ্ট রোজাদারের সওয়াব বিন্দুমাত্র কমানো হবে না। যে ব্যক্তি (ইফতারের পর) কোনো রোজাদারকে পেটভরে (সন্তুষ্ট করে) খাওয়াবেন, তাকে আল্লাহ তায়ালা আমার (জন্য বরাদ্দ) হাউসের পানি দ্বারা এমনভাবে তৃষ্ণা মিটিয়ে তৃপ্ত করবেন, সেই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত পিপাসার্ত হবেন না। এ মাসের প্রথম দশক রহমত, দ্বিতীয় দশক গোনাহ থেকে ক্ষমা এবং শেষ দশক জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের। যে ব্যক্তি এ মাসে ক্রীতদাসকে তার কাজ কমিয়ে দেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেবেন। এ মাসে চারটি কাজ অধিক পরিমাণে চর্চা করা। এর মধ্যে দুটি কাজ এমন, যার মাধ্যমে তোমরা নিজের পালনকর্তাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে। তা হলো- ১. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ জিকির করা। ২. আল্লাহ তায়ালার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকা। অন্য দুইটি কাজ হলো এমন, যা থেকে কখনও তোমরা মুখাপেক্ষিহীন হতে পারবে না। তা হলো- ১. জান্নাত প্রার্থনা করা। ২. জাহান্নাম থেকে মুক্তি কামনা করা। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের জন্য অবশ্যই উজ্জ্বল জীবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুন্দর গাইডলাইন। রমজানকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) তথা ইসলামে বাড়তি গুরুত্ব দেয়ার পেছনে শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, যৌক্তিক অসংখ্য কারণ রয়েছে। এটিকে ইসলাম প্রশিক্ষণের মাস বলেও আখ্যায়িত করা যায়। এ মাসে অভিশপ্ত শয়তানকে শৃঙ্খলিত বা নিয়ন্ত্রিত করে রাখা হয়। ইসলামের আলোকে জীবন পরিচালনা করার প্রতিটি কর্ম বা পর্বকে ব্যাপক উৎসাহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, অন্য সময়ের নফল এ মাসে ফরজ বলে স্বীকৃতি পাবে এবং একেকটি ফরজ ৭০ গুণ বেশি সওয়াব অর্জন করবে। স্বাভাবিক জীবনেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরস্কার ঘোষণা করা হলে বা বিশেষ ছাড় দেয়া হলে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যুক্ত হতে বেশি আগ্রহ দেখাই। কর্তৃপক্ষও একই উদ্দেশে সেসব অফার দিয়ে থাকে। এখানেও ইসলাম তা-ই করেছে। সঙ্গে মানুষের মন যেন গোনাহের কাজের দিকে অন্য সময়ের মতোই সহজে ধাবিত হতে না পারে, সেজন্য অভিশপ্ত শয়তানকেও এ সময় স্বাভাবিক অপতৎপরতা পরিচালনা করতে দেয়া হয়নি। তাকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়। ইসলাম বলেছে, এ মাসে আল্লাহ তায়ালা বান্দার জন্য বিশেষ সুযোগ দিয়ে তাকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করতে চান। এমনকি এজন্য তিন ধরনের বিশেষ অফারও দেয়া হয়েছে। প্রথম দশকে রহমত, দ্বিতীয় দশকে গোনাহ মাফ এবং শেষ দশকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের অকল্পনীয় সম্ভাবনা ও সুবর্ণ সুযোগ। যথাযথ গুরুত্বসহকারে উপরে বর্ণিত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রদত্ত ভাষণ অনুসরণ করলে এ মাসে একটি লোক যার সারাটি জীবন গোনাহে মোড়ানো ছিল, সেও খাঁটি মোমিন এমনকি আল্লাহর অলিও হয়ে উঠতে পারেন। বাস্তবে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেও থাকে। রমজানে অসংখ্য মানুষ নামাজ শুরু করেন, রোজা রাখতে শুরু করেন, হজ করার নিয়ত করেন, ওমরা পালন করে থাকেন, সুদি জীবন বর্জনের অঙ্গীকার করেন, বাকি জীবন মিথ্যা না বলার, কাউকে ধোঁকা না দেয়ার, কারও ওপর জুলুম না করার, এতিম-গরিব-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, কোরআন-হাদিস মসজিদ-মাদরাসা তথা ইসলামের পক্ষে অবদান রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার করেন। আরও বিভিন্ন উপায়ে নষ্ট ও কালো জীবনকে বর্জন করে বেহেশতি মানুষ বনে যাওয়ার ভূরি ভূরি ঘটনা প্রতি বছর রমজানে ঘটে থাকে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর ভাষণে রমজানে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি-নেক আমল সম্পাদনের জন্যই শুধু তাগিদ দেয়া হয়নি, একইসঙ্গে নেতিবাচক তথা সব ধরনের গোনাহের কাজ এড়িয়ে চলতেও বিশেষভাবে বলা হয়েছে। এমনকি গোনাহের কাজ বর্জন করতেই দ্বিগুণ তাগিদ দেয়া হয়েছে। কারণ রমজানের প্রথম দশকটিকে রহমতের ঘোষণা করা হলেও দ্বিতীয় দশককে গোনাহ থেকে ক্ষমা লাভ এবং তৃতীয় দশককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। গোনাহ থেকে ক্ষমা লাভ করা মানেই গোনাহের কাজ বর্জন করার পাশাপাশি অতীতে কৃত গোনাহের জন্য অনুশোচনা বা তওবা করা বোঝায়। এর সঙ্গে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করতে বলা হয়েছে, বাক্যটিতে জান্নাত লাভ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়নি। এরও তাৎপর্য হলো, জাহান্নামের পথে ঠেলে দেয় গোনাহের কাজ। অতএব সেসব থেকে বেঁচে থাকা চাই। দ্বিতীয় ও শেষ দশকের সুযোগকে কাজে লাগাতে পারলে প্রথম দশকের রহমত প্রাপ্তি অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং পূর্ণতা লাভ করে। ফলে সংশ্লিষ্ট বান্দার দুনিয়ার জীবনও উজ্জ্বল ও শান্তিময় হয়।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়