Saturday, June 13

ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য প্রয়োজন এখলাস


মাওলানা মুনীরুল ইসলাম: মানুষের ইবাদত-বন্দেগি কবুল হওয়ার জন্য শর্ত হলো এখলাস বা নিয়ত পরিশুদ্ধ হওয়া। তা না হলে কোনো ইবাদতই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। নিয়ত হলো কোনো কিছু করার ইচ্ছা করা। যখন কেউ শুধু আল্লাহ তায়ালার জন্য ইবাদত করে সেটাকে 'এখলাস' বলা হয়। আর যখন কেউ লোক দেখানো বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ইবাদত করে সেটাকে 'রিয়া' বলা হয়। কেবল নিয়তের ওপরই সব নেকি-বদি নির্ভর করে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সব কাজকর্মের মূলে নিয়ত বা সঙ্কল্পই হচ্ছে প্রধান। আল্লাহ তায়ালা বান্দার নিয়ত বা উদ্দেশ্য দেখে থাকেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের বাহ্যিক চেহারা-সুরতের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না। তিনি শুধু অন্তরের গভীরতম সুপ্ত ধ্যান-ধারণা ও উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করেই কাজের ফল নির্ণয় করেন। শুধু খাঁটি নিয়তের অসিলায়ই আল্লাহর দরবারে ইবাদত-বন্দেগি কবুল হতে পারে। একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত মায়াজ (রা.) কে উদ্দেশ করে বললেন, 'হে মায়াজ! ইবাদত-বন্দেগি অল্পই করো তাতে বাধা নেই। তবে ইবাদত যেটুকু করবে, অতি খাঁটি নিয়তে করবে। নিজের মন-দিল সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার ওপর সমর্পণ করবে।' তিনি আরও বলেন, 'তোমার ঈমানকে খাঁটি করো, অল্প আমলই নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে।' কেউ যদি শুধু আলো-হাওয়ার নিয়তে ঘরের জানালা রাখে, তাহলে সে শুধু আলো-হাওয়াই খেতে পারবে, সওয়াব পাবে না। আর যদি আজান শোনার জন্য জানালা রাখে, তাহলে সওয়াবও পাবে, আলো হাওয়াও পাবে। যদি কেউ হজের নিয়তে গৃহ পরিত্যাগ করে, সে হজের সওয়াব পাবে। আর যে বা যারা বিবাহ-শাদি বা ধনদৌলত লাভের নিয়তে সফর করে তাহলে সফরের কষ্ট ভোগের বিনিময়ে সওয়াব বা পুণ্য কিছুই পাবে না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তোমাদের অন্তরে যা আছে, তা প্রকাশ কর কিংবা গোপন করো, আল্লাহ তা পাই পাই করে হিসাব নেবেন।' অর্থাৎ তোমাদের কর্ম, চক্ষু ও অন্তরকে জিজ্ঞেস করা হবে এবং তাদের সব কাজের পূর্ণাঙ্গ হিসাব-নিকাশ নেয়া হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রোজ হাশরে প্রত্যেকের নিয়ত-উদ্দেশ্য অনুযায়ী বিচার করা হবে। ওই দিনই টের পাওয়া যাবে, কে কী নিয়তে কি ধারণা নিয়ে কাজ বা আমল করেছে।' রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এ নশ্বর দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসায় মাতোয়ারা থাকে এবং দুনিয়াপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে থাকে, তার অভাব ও দরিদ্রতা কোনোকালে দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর যে ব্যক্তি পরকালের নিয়তে আমল করে, এসব লোকের এ নিয়তের কারণে মন-দিল সর্বদা উৎফুল্ল থাকে। মাহে রমজানের নামাজ, রোজা, তারাবি, তাসবিহ, তেলাওয়াত, ইতিকাফ বা অন্য যে কোনো সময়ের যে কোনো ইবাদত আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে করলে সেটা আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। আগেকার সলফে সালেহিনরা কোনো আমল করার আগে তাদের নিয়ত বিশুদ্ধ করে নিতেন। এখলাস না থাকলে তার পরিণতি কী হবে এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আমি ছাড়া অন্যের সন্তুষ্টির জন্য তারা যেসব আমল করবে, আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করব, এরপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণা করে দেব।' (সূরা ফোরকান : ২৩)। মনীষীরা বলেন, রিয়াকারের উপমা সেই ব্যক্তির মতো, যে পাথরকণা দ্বারা পরিপূর্ণ ব্যাগ নিয়ে বাজারে গেল। তখন লোকেরা তার ব্যাগ দেখে বলল, দেখ তার ব্যাগে কত টাকা! এতে সে খুব খুশি হলো। অথচ এ পাথরভর্তি ব্যাগ দিয়ে মানুষের প্রশংসা কুড়ানো ব্যতীত সে কিছুই করতে পারবে না। রিয়াকারও পরকালে আল্লাহ তায়ালার কাছে কিছুই পাবে না। মুহাম্মদ ইবনে লবিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'আমি তোমাদের ব্যাপারে ছোট শিরক থেকে খুব ভয় করছি। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! ছোট শিরক কী? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তা হলো রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদত। যেদিন আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের আমলের পুরস্কার দেবেন, সেদিন রিয়াকারদের বলবেন, যাও, দুনিয়াতে যাদের দেখানোর জন্য আমল করতে, তাদের কাছে যাও। দেখ তাদের কাছে কোনো পুরস্কার পাও কিনা। (মুসনাদে আহমদ)। তবে ফকিহ আবু লাইস সমরকন্দি 'তাম্বিহুল গাফেলিন' কিতাবে বলেছেন, কারও নিয়তে যদি রিয়া থাকে, তবুও ইবাদত পরিত্যাগ করা যাবে না। বরং মন থেকে রিয়া দূর করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেছেন, 'রিয়ার ভয়ে ইবাদত পরিত্যাগ করাও একরকম রিয়া।' আমল ঠিক করার চেয়ে এখলাস ঠিক করা বেশি কঠিন। কেননা আমল দেখা যায় এবং ঠিক না ভুল হচ্ছে সেটা নিজে না বুঝলেও অন্যরা বুঝতে পারে। অন্যরা বুঝতে পারলেও সে অনুযায়ী সংশোধন করা যায়। কিন্তু এখলাস দেখা যায় না এবং অন্যেও এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে পারে না। তাই এটা একান্তই প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাপার এবং নিজেদেরই এ ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। অতএব আসুন, আমরা পরিশুদ্ধ নিয়তে এখলাসপূর্ণ ইবাদত করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের রেজামন্দি অর্জন করি এবং ইহ ও পরকালে প্রভূত কল্যাণ লাভে ধন্য হই।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়