Wednesday, June 10

মা-বাবার মৃত্যুর পর তাদের জন্য করণীয় আমল


মা-বাবা ছোট শব্দ, কিন্তু এ দুটি শব্দের সাথে কত যে আদর, স্নেহ, ভালবাসা রয়েছে তা পৃথিবীর কোনো মাপযন্ত্র দিয়ে নির্ণয় করা যাবে না। মা-বাবা কত না কষ্ট করেছেন, না খেয়ে থেকেছেন, অনেক সময় ভালো পোশাকও পরিধান করতে পারেননি, কত না সময় বসে থাকতেন সন্তানের অপেক্ষায়। সেই মা-বাবা যাদের চলে গিয়েছেন, তারাই বোঝেন মা বাবা কত বড় সম্পদ। যেদিন থেকে মা-বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন সেদিন থেকে মনে হয় কী যেন হারিয়ে গেল, তখন বুক কেঁপে ওঠে, চোখ থেকে বৃষ্টির মতো পানি ঝরে, কী সান্ত¦নাই বা তাদের দেয়া যায়! সেই মা-বাবা যাদের চলে গিয়েছে তারা কি মা-বাবার জন্য কিছুই করবে না?। এত কষ্ট করে আমাদের কে যে মা-বাবা লালন পালন করেছেন তাদের জন্য আমাদের কি কিছুই করার নেই? অবশ্যই আছে। আলোচ্য প্রবন্ধে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে মৃত মা-বাবা জন্য কী ধরনের আমল করা যাবে এবং যে আমলের সওয়াব তাদের নিকট পৌছবে তা উল্লেখ করা হলো : ১. বেশি বেশি দুয়া করা মা-বাবা দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর সন্তান মা-বাবার জন্য বেশি বেশি দুয়া করবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দুয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কী দুয়া করবো তাও শিক্ষা দিয়েছেন । আল কোরআনে এসেছে, ‘হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’ [সূরা বানী ইসরাইল : ২৪] ‘হে আমাদের রব, রোজ কিয়ামতে আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিনকে ক্ষমা করে দিন’ [সুরা ইবরাহীম : ৪১] এছাড়া আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পিতা-মাতার জন্য দুয়া করার বিশেষ নিয়ম শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন : ‘হে আমার রব! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন এবং ধ্বংস ছাড়া আপনি জালিমদের আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না’ [সূরা নুহ : ২৮] । মা-বাবা এমন সন্তান রেখে যাবেন যারা তাদের জন্য দোয়া করবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩টি আমল বন্ধ হয় না- ১. সাদকায়ে জারিয়া ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দুয়া করে [সহিহ মুসলিম : ৪৩১০] মূলত জানাজার নামাজ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির জন্য দুয়া স্বরূপ। ২. দান-ছাদকাহ করা, বিশেষ করে সাদাকায়ে জারিয়া প্রদান করা মা-বাবা বেঁচে থাকতে দান-সাদকাহ করে যেতে পারেননি বা বেঁচে থাকলে আরো দান-সাদকাহ করতেন, সেজন্য তাদের পক্ষ থেকে সন্তান দান-সাদকাহ করতে পারে। হাদিসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন : ‘জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমার মা হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই কোনো অছিয়ত করতে পারেননি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-ছাদকা করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে ছাদকা করলে তিনি কি এর ছাওয়াব পাবেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন।’ [সহীহ মুসলিম : ২৩৭৩] তবে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে সাদকায়ে জারিয়া বা প্রবহমান ও চলমান সাদাকা প্রদান করা। যেমন পানির কূপ খনন করা, (নলক‚প বসানো, দ্বীনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, কোরআন শিক্ষার জন্য মক্তব ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, স্থায়ী জনকল্যাণমূলক কাজ করা। ইত্যাদি। ৩. মা-বাবার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন মা-বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় যদি তাদের কোনো মানতের সিয়াম কাজা থাকে, সন্তান তাদের পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করলে তাদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : অর্থ : ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল এমতাবস্থায় যে তার ওপর রোজা ওয়াজিব ছিল। তবে তার পক্ষ থেকে তার ওয়ারিসগণ রোজা রাখবে’ [সহিহ বুখারি :১৯৫২]। অধিকাংশ আলেমরা এ হাদিসটি শুধু ওয়াজিব রোজা বা মানতের রোজার বিধান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে নফল সিয়াম রাখার পক্ষে দলিল নেই। ৪. হজ বা উমরাহ করা মা-বাবার পক্ষ থেকে হজ বা উমরাহ করলে তা আদায় হবে এবং তারা উপকৃত হবে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, : ‘জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আগমন করে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার মা হজ করার মানত করেছিলেন কিন্তু তিনি হজ সম্পাদন না করেই মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ কর। তোমার কি ধারণা যদি তোমার মার ওপর ঋণ থাকত তবে কি তুমি তা পরিশোধ করতে না? সুতরাং আল্লাহর জন্য তা আদায় কর। কেননা আল্লাহর দাবি পরিশোধ করার অধিক উপযোগী’ [সহিহ বুখারি : ১৮৫২] তবে মা-বাবার পক্ষ থেকে যে লোক হজ বা ওমরাহ করতে চায় তার জন্য শর্ত হলো সে আগে নিজের হজ-ওমরাহ করতে হবে। ৫. মা-বাবার পক্ষ থেকে কোরবানি করা মা-বাবার পক্ষ থেকে কোরবানি করলে তার ছাওয়াব দ্বারা তারা উপকৃত হবে। এ বিষয়ে হাদিসে এসেছে : আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি শিংযুক্ত দুম্বা উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলেন, যার পা কালো, চোখের চতুর্দিক কালো এবং পেট কালো। অতঃপর তা কোরবানির জন্য আনা হলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন, হে আয়েশা! ছুরি নিয়ে আস, তারপর বললেন, তুমি একটি পাথর নিয়ে তা দ্বারা এটাকে ধারালো কর। তিনি তাই করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুরি হাতে নিয়ে দুম্বাটিকে শুইয়ে দিলেন। পশুটি জবেহ্ করার সময় বললেন, বিসমিল্লাহ, হে আল্লাহ তুমি এটি মুহাম্মাদ, তার বংশধর এবং সব উম্মাতে মুহাম্মাদির পক্ষ থেকে কবুল কর’। এভাবে তিনি তা দ্বারা কোরবানি করলেন। [ সহিহ মুসলিম : ৫২০৩] ৬. মা-বাবার ওসিয়ত পূর্ণ করা মা-বাবা শরিয়াসম্মত কোনো ওসিয়ত করে গেলে তা পূর্ণ করা সন্তানদের ওপর দায়িত্ব। রাশিদ ইবন সুয়াইদ আসসাকাফি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা একজন দাসমুক্ত করার জন্য ওসিয়ত করে গেছেন। আর আমার নিকট কালো একজন দাসি আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ডাকো, সে আসল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার রব কে ? উত্তরে সে বলল, আমার রব আল্লাহ। আবার প্রশ্ন করলেন আমি কে ? উত্তরে সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও; কেননা সে মু’মিনা । [সহিহ ইবন হিববান :১৮৯] ৭. মা-বাবার বন্ধুদের সম্মান করা মা-বাবার বন্ধুদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, সম্মান করা, তাদের দেখতে যাওয়া, তাদের হাদিয়া দেয়া। এ বিষয়ে হাদিসে উল্লেখ আছে, : আব্দুল্লাহ ইবনে দিনার রাদিয়াল্লাহু আনহু আবদুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, একবার মক্কার পথে চলার সময় আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর এক বেদুইনের সাথে দেখা হলে তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং তাকে সে গাধায় চড়ালেন যে গাধায় আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা উপবিষ্ট ছিলেন এবং তাঁর (আবদুল্লাহ) মাথায় যে পাগড়িটি পরা ছিল তা তাকে প্রদান করলেন। আবদুল্লাহ ইবান দিনার রাহেমাহুল্লাহ বললেন, তখন আমরা আবদুল্লাহকে বললাম : আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক! এরা গ্রাম্য মানুষ : সামান্য কিছু পেলেই এরা সন্তুষ্ট হয়ে যায় (এতসব করার কি প্রয়োজন ছিল?) উত্তরে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তার পিতা, (আমার পিতা) উমার ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর বন্ধু ছিলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি ‘পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ভালো ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় সওয়াবের কাজ’ [সহিহ মুসলিম : ৬৬৭৭]। মৃতদের বন্ধুদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলও আমাদের উৎসাহিত করে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোনো বকরি জবেহ করতেন, তখনই তিনি বলতেন, এর কিছু অংশ খাদিজার বান্ধবীদের নিকট পাঠিয়ে দাও [সহিহ মুসলিম : ৬৪৩১] মূল : হাবিবুল্লাহ মুহাম্মাদ ইকবাল অনুবাদক : আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়