মুফতি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ:
অসুস্থ বা ওজর অবস্থায় নামাজ আদায়ের শরিয়তসম্মত বিস্তারিত বিবরণ সংবলিত বিধিবিধান যে গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায় তাতে তিনটি অবস্থানের কথা উল্লেখ আছে। যথা : ১. দাঁড়িয়ে ২. বসে ও ৩. শায়িত অবস্থায়। অর্থাৎ দাঁড়িয়ে ইশারার দ্বারা রুকু-সিজদা আদায়ের মাধ্যমে। আর বসা অবস্থায় যথানিয়মে সিজদা এবং ঝুঁকে রুকু আদায়ের মাধ্যমে। যথানিয়মে সিজদা সম্ভব না হলে ইশারার মাধ্যমে তা করা যাবে। আর বসার ক্ষেত্রে আত্তাহিয়্যাতুর সুরতে বসতে বেশি কষ্ট হলে আসন গেড়ে বসে, অথবা যেভাবে বসতে কষ্ট কম হয় সেভাবেই বসে নামাজ আদায় করা যাবে। আর শায়িত অবস্থায় চিত হয়ে পা গুটিয়ে হাঁটু উঁচু করে, মাথা ও মুখমন্ডল যথাসম্ভব কেবলামুখী করে ইশারার দ্বারা নামাজ আদায় করা। অথবা ডান বা বাম কাতে শায়িত অবস্থায় কেবলামুখী হয়ে নামাজ আদায় করা। এসব অবস্থার মধ্যে সবই অবস্থাভেদে অসুস্থ ব্যক্তির গ্রহণ করা জায়েজ। তবে কোনোটি উত্তম আবার কোনোটি বেশি উত্তম। কিন্তু চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করার বিষয়টি, প্রক্রিয়া বা বৈধতা ও 'বিকল্প পন্থা' হওয়ার কথা রাসুল (সা.) এর যুগ এবং সাহাবাদের যুগ থেকে শুরু করে গবেষক ইমামদের যুগ পেরিয়ে হিজরি পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত লিখিত বা রচিত কোনো কিতাবে যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি প্রামাণ্য তিন যুগ বা তার পরের কোনো যুগে বা শতাব্দীতে সাহাবি, তাবেয়ি, আলেম ও অলি কারও গ্রন্থাদিতে বা পরস্পর আচরিত রীতিতে তার কোনো নজির পাওয়া যায় না। সুতরাং-
১. এসব মৌলিক দিক বিবেচনায় চেয়ারে বসে ফরজ, ওয়াজিব ও মুয়াক্কাদা নামাজ আদায়ের উদাহরণ বের করা যায় না।
২. যেখানে একজন অসুস্থ ব্যক্তির জন্য খোদ শরিয়া আইনে সুবিধামতো নামাজ আদায়ের অনেক 'বিকল্প পন্থা' বলে দিয়েছে সেখানে সেসব বাদ দিয়ে অন্য নতুন 'বিকল্প পন্থা' অর্থাৎ চেয়ারে বসে নামাজ আদায়ের সুযোগ দানের অবকাশ কম পায়।
৩. নামাজের সব ফরজ রোকনের মধ্যে সিজদা করা তথা মাটিতে নাক, কপাল, মাথা স্পর্শ করে সর্বোচ্চ বিনয় ও দীনতা-হীনতার স্বাক্ষর রাখা, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। যে কারণে একজন অসুস্থ রোগী যিনি দাঁড়িয়ে হোক বা বসে হোক উভয় অবস্থায় ইশারা ব্যতীত নামাজ আদায়ে সক্ষম নন, তার বেলায় বলা হয়েছে, বসে নামাজ আদায়ই তার পক্ষে উত্তম। অথচ বসে আদায়ের ক্ষেত্রে ১৩টি ফরজের অন্যতম কিয়াম বা দাঁড়ানো ফরজটি বাদ পড়ে যাচ্ছে। তবুও সেটি উত্তম কেন? উত্তম হচ্ছে যে সিজদা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আদায় করতে হয়, বসা অবস্থায় সেই মাটির অধিক কাছাকাছি অবস্থান হয়ে থাকে, সেজন্য। চেয়ারে বসা অবস্থায় কি মাথা-কপাল মাটি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না?
৪. চেয়ারে বসে নামাজ আদায়ে ইবাদতের প্রাণরূপ সর্বোচ্চ দীনতা-হীনতা প্রকাশের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয় না।
৫. মসজিদে চেয়ার ঢুকিয়ে তাতে আসন গ্রহণ করা, রাজাধিরাজ, শাহান শাহ আহকামুল হাকেমিনের শাহি দরবারের আদব পরিপন্থি।
৬. চেয়ার দ্বারা মসজিদে জামাতের কাতারের বিঘ্ন ঘটে। তাই মসজিদে চেয়ার ঢুকানো ঠিক নয়।
৭. জামাত-কাতার ব্যতীত তাতে মসজিদের স্বাভাবিক ও মৌলিক সৌন্দর্য, সবার সমান বিনয়ী অবস্থানের বিঘ্ন ঘটে।
৮. একান্ত প্রয়োজন (সাময়িক বয়ান/আলোচনা, যখন বক্তা/আলোচক বৃদ্ধ-বয়স্ক হন) ব্যতীত মসজিদে চেয়ারের আসন পাতায় বিধর্মীদের সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে থাকে। অথচ ধর্মীয় বিষয়াদিতে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সাদৃশ্য ইসলামী শরিয়তে নিষেধ করা হয়েছে।
৯. নফল নামাজে 'কিয়াম' বা দাঁড়ানো ফরজ নয় বিধায় এবং সফর অবস্থায় বাহনে বসে তা আদায়ের অনুমতির ওপর ভিত্তি করে একজন রোগীর বেলায় তেমনিভাবে চেয়ারে বসে নামাজ আদায়ের বৈধতা বের করা যায় না। তার কারণ 'মাকি্বছ' ও 'মাকি্বছ আলাইহি' এক বা সমান নয়। অর্থাৎ ফরজ, নফল, সফর অবস্থা ও বাসাবাড়িতে অবস্থানের অবস্থা ভিন্ন, তাই এসব ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা ও বিধান ভিন্ন ভিন্ন।
১০. ফিকহ-ফাতাওয়ার আকর গ্রন্থাদিতে একজন রোগীর ক্ষেত্রে চেয়ারে বসে নামাজ পড়ার কোনো প্রসঙ্গ নেই। তবে আধুনিক সময়ে তথা বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ছাপানো কোনো কোনো উর্দু বা আরবি ফতোয়া গ্রন্থে প্রসঙ্গটি স্থান পেলেও তাতে প্রথমত সমস্যাটির সমাধান ুস্পষ্টভাবে আসেনি। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্টরা সমস্যার গভীরে যাননি এবং ব্যতিক্রম হিসেবে বা বিশেষ কারও ক্ষেত্রে আইনগত বৈধতা দানের সুযোগে তার ভবিষ্যৎ মন্দ ফল কী দাঁড়াবে (যা বর্তমানে মসজিদগুলোতে চেয়ারের সারি রেখে, বোঝা যাচ্ছে) তা তারা অনুমান করতে পারেননি।
১১. বোখারি ও মুসলিমের বর্ণনা মতে, প্রিয়নবী (সা.) ঘোড়া থেকে পড়ে আহত হয়েছিলেন এবং বসে বসে নামাজ পড়িয়েছেন। চেয়ারে বসে নামাজ পড়েননি।
১২. একান্ত গবেষণা-বিতর্কের খাতিরে যদি কারও বেলায় এমনটি বলা হয় যে, তিনি দাঁড়িয়েও নামাজ পড়তে পারেন না এবং চেয়ার ব্যতীত যে কোনো প্রক্রিয়ায় বসেও পারেন না, তাহলে এমনভাবে ও এমন জায়গায় বসতে হবে যাতে দীনতা-হীনতা প্রকাশ পায়। তবে চেয়ারে বসে নামাজ এর অনুমতি প্রযোজ্য হতে পারে বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত তথা মসজিদের বাইরের ক্ষেত্রে; মসজিদ নয়। কারণ, তার প্রয়োজনে মসজিদের পরিবেশ ব্যাহত করা যাবে না এবং তিনি রোগী বিধায় তার পক্ষে মসজিদে জামাতে অংশগ্রহণও জরুরি নয়।
বিষয়টি সম্পর্কে দেশের বিজ্ঞ মুফতিদের আরও গভীরে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি এবং সংশ্লিষ্ট রোগীদের কষ্টসাধ্য নামাজ যেন বাতিল না হয়ে যায় সে সতর্কতা অবলম্বন করার অনুরোধ করছি।
তথ্য সূত্র
১. বোখারি : খন্ড ১, হাদিস নং ৭৩২
২. মুসলিম : খন্ড২, হাদিস নং ৮৭৬
৩. আবু দাউদ : খন্ড ১ পৃ. ১৭৯; হাদিস নং ৬৬৭
৪. নাসায়ি শরিফ : খন্ড ১, পৃ-১৩১
৫. সুনানে বায়হাকি : হাদিস নং ৩৬৬৯ ও ৩৬৭২
৬. ফাতহুল বারী : খ-২, পৃ-১৭৮
৭. আদ্দদুররুল মুখতার+শামী : খন্ড২, পৃ-৯৫-৯৭; এইচএম সাঈদ এডুকেশনাল প্রেস, করাচি
৮. আদ্দদুররুল মুখতার+শামী : খ-২, পৃ-৪০৭, ৫৬৪, ৫৬৯; যাকারিয়া বুক ডিপো, দেওবন্দ, ভারত
৯. তাতার খানিয়া : খ-২, পৃ-৬৬৭
লেখক : মুফতি, গবেষণা বিভাগ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
Monday, May 4
এ সম্পর্কিত আরও খবর
জমাদিউল আউয়াল মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকীআরবের শীতকাল জমাদিউল আউয়াল। আরবি বর্ষপঞ্জি বা হিজরি সনের পঞ্চম মাস হল
যে ৩ শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করেন ফাইল ফটোবিপদ-আপদ কিংবা কল্যাণ কামনা- সব ক্ষেত্রেই মুমিনের একমাত্র ভরসা মহান রাব্বুল আলামিন। প
ঘূর্ণিঝড়ের সময় যে দোয়া পড়বেন ঘূর্ণিঝড়, ঝড়ো বাতাসসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্ত থাকতে
ইতিহাসের প্রথম জুমা যেমন ছিল‘জুমা’ শব্দের অর্থ এক জায়গায় জড়ো হওয়া বা কাতারবদ্ধ হওয়া। শুক্রবার মসজিদে জোহরের চার রাকাতের পরিবর্ত
অহংকার আর অহংকারীর ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে ইসলাম যা বলছে আমাদের সমাজে একটি কথা বহুল প্রচলিত, তা হলো- ‘অহংকার পতনের মূল’। প্রতিটি মানুষের মধ্যে দুটি শক
ল্যাপটপের ব্যাটারির চার্জ ধরে রাখার উপায় কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: বর্তমানে ডেস্কটপ কম্পিউটারের ব্যবহার দিন দিন কমে যাচ্ছে। বাড়ছে ল্যাপটপের
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়