Tuesday, May 5

মুরাবাহা এবং সুদ প্রসঙ্গ


মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব: ইসলামী ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মুরাবাহাকে অর্থায়ন পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতার শিকার হতে হয়। বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের একটি মহল দাবি করেন, মুরাবাহা পদ্ধতিতে অর্থায়ন করলে যেহেতু বাকিতে পণ্য বিক্রি করা হয় আর পণ্যের মূল্য নগদের তুলনায় বাকিতে বেশি রাখা হয়, তাই এটি সুদি ঋণের মতো হয়ে যায়। সুদি ঋণে যেমন সময়ের বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থগ্রহণ করা হয়, তেমনি বাকিতে বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও সময়ের বিনিময়ে অতিরিক্ত মূল্যগ্রহণ করা হয়। বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের দাবি অনুযায়ী মুরাবাহা পণ্যের মূল্য বিলম্বে আদায় করার কারণে পণ্যের দাম বেশি রাখা আর সুদি ঋণের বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থগ্রহণ করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আসলে এ ধারণাটি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে যে যুক্তি পেশ করা হয়, তা সঠিক নয়। শরিয়তের কিছু উসুল বা মৌলিক নীতি সম্পর্কে জানা থাকলে এ ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হবে। এ আপত্তির জবাবের আগে নীতিগুলো জেনে নিই। প্রথম নীতি : প্রচলিত লেনদেনে মুদ্রা ও পণ্যের মাঝে পার্থক্য করা হয় না। কিন্তু শরিয়ত মুদ্রা ও সাধারণ পণ্যের মাঝে তারতম্য করে থাকে। সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে মুদ্রা যেমন একটির বিনিময়ে অপরটিকে কমবেশি করে লেনদেন করা বৈধ, তেমনি পণ্যও একটির বিনিময়ে অপরটির লেনদেন কমবেশি করে বৈধ। তবে শরিয়তের দৃষ্টিতে একটি পণ্য দ্বারা সমমূল্যের ও সমমানের অপর পণ্য যেমন কমবেশি করে লেনদেন বৈধ, তেমনি একটি মুদ্রার বিনিময়ে সমমূল্যের অপর মুদ্রা কমবেশি করে লেনদেন বৈধ নয়। দ্বিতীয় নীতি : মুদ্রার নিজস্ব ভ্যালু নেই। মুদ্রা সরাসরি ভোগ করা যায় না। এটি শুধু পণ্য বা সেবা অর্জনের মাধ্যম। পক্ষান্তরে পণ্যের নিজস্ব ভ্যালু আছে। পণ্য দ্বারা সরাসরি উপকৃত হওয়া যায়। ভোগ করা যায়। তৃতীয় নীতি : মুদ্রা একটি অপরটির সঙ্গে ১০০ শতাংশ সমান। চাই মুদ্রা নতুন হোক বা পুরনো। অপরদিকে পণ্য একটি অপরটির সঙ্গে ১০০ শতাংশ সমান নয়; পার্থক্য আছে। একটি নতুন মোবাইল ও একটি ব্যবহৃত পুরনো মোবাইল এক দামের নয়। উভয়টির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তবে একটি নতুন ৫০০ টাকার নোটের মান অপর একটি পুরনো ৫০০ টাকার নোটের মান ১০০ শতাংশ সমান। নোট পুরনো হয়ে যাওয়ার কারণে তার মান কমে যায়নি। চতুর্থ নীতি : ক্রয়-বিক্রয়ে পণ্য নির্দিষ্ট করলে নির্দিষ্ট হয়। পক্ষান্তরে মুদ্রা নির্দিষ্ট করলেও নির্দিষ্ট হয় না। যেমন মনে করুন, আবদুল্লাহ একটি মোবাইল সেটের দিকে ইঙ্গিত করে আবদুর রহিমের কাছে বিক্রি করল। তাহলে এ বিক্রয় চুক্তিতে ইঙ্গিতকৃত মোবাইল সেটটিই বিক্রয় হবে। আবদুল্লাহ যদি পরবর্তী সময় বলে যে, সে নির্দিষ্টকৃত মোবাইল সেটটির পরিবর্তে অন্য মোবাইল দেবে, তবে তা আবদুর রহিমের সম্মতি ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। কারণ বিক্রয় চুক্তিতে যে মোবাইল সেটটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা বিক্রয় পণ্য হিসেবে নির্ধারিত হয়ে গেছে। তার পরিবর্তে অন্যটি দেয়ার সুযোগ নেই। অপরদিকে আবদুল্লাহ যদি ৫০০ টাকার একটি নোট বের করে সেটির দিকে ইঙ্গিত করে কারও কাছ থেকে ওই টাকার বিনিময়ে কোনো জিনিস খরিদ করে, তাহলে সেই চুক্তিতে ওই ইঙ্গিতকৃত টাকাটাই নির্দিষ্ট হবে না; বরং ইঙ্গিতকৃত টাকার পরিবর্তে অন্য টাকাও দেয়া যাবে। শর্ত হচ্ছে, চুক্তিকৃত পরিমাণ টাকা দেয়া লাগবে। এসব পার্থক্য বিবেচনায় শরিয়ত মুদ্রা ও পণ্যের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। তাই মুদ্রার একটি একক ঠিক সেই মূল্যমানের অন্য একটি এককের সঙ্গে কমবেশি করে লেনদেন জায়েজ নয়। এটি সুদ। কিন্তু পণ্যের ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়তের আচরণ ভিন্ন। পণ্যের যেহেতু নিজস্ব ভ্যালু আছে, তাছাড়া পণ্যের সঙ্গে মুদ্রার অনেক বিষয়েই অমিল রয়েছে, তাই একই মানের একটি পণ্যকে দুইটি বা তিনটি পণ্যের বিনিময়ে লেনদেন করতে কোনো বাধা নেই। কারণ মালিক তার পণ্য যে কোনো মূল্যেই বিক্রি করার অধিকার সংরক্ষণ করে। তবে শর্ত হচ্ছে কোনো প্রতারণা ও মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারবে না। সুতরাং বাকিতে লেনদেনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অংশ তখনই সুদ হিসেবে গণ্য হবে যখন উভয় দিক থেকে চুক্তি মুদ্রার ওপর হবে। কিন্তু কোনো একদিকে যদি পণ্য থাকে অথবা পণ্যকে মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করা হয় তাহলে বিক্রেতা পণ্যের দাম যে কোনোভাবেই নির্ধারণ করতে পারে। বিক্রেতা বিভিন্ন দিক লক্ষ্য করে নগদের চেয়ে বাকিতে বেশি মূল্য চাইতে পারে। ক্রেতা যদি তার বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে পণ্যটি গ্রহণ করতে সম্মতি জ্ঞাপন করে, তাহলে এখানে নাজায়েজ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের সমাজে অনেক দোকানদার আছেন খাঁটি পণ্য বিক্রি করে থাকেন। তাদের কাছ থেকে বেশি মূল্যেও মানুষ পণ্য খরিদ করে থাকেন। যদিও সেই পণ্যটিই অন্য দোকানে কম মূল্যে পাওয়া যায়। আবার অনেক সময় বিশ্বস্ত লোকের কাছেও বেশি মূল্যে পণ্য খরিদ করতে দেখা যায়। সুতরাং কোনো বিক্রেতা যদি তার ক্রেতার কাছ থেকে এজন্য বেশি মূল্য গ্রহণ করে যে, সে তাকে বাকির সুবিধা দিচ্ছে অথবা অন্য কোনো সুবিধা দিচ্ছে, তাহলে তা নাজায়েজ হওয়ার কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না। কাজেই বাকির সুবিধা বা অন্য কোনো সুবিধা দেয়ার কারণে যদি বিক্রেতা অতিরিক্ত মূল্য গ্রহণ করে, তাহলে একথা বলা যাবে না যে, অতিরিক্ত টাকাটা সময়ের বিনিময়ে গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ সময়ের বিনিময়ে হলে তো তার সময় বাড়লে টাকাও বাড়বে বা টাকার বিনিময়ে সময় বৃদ্ধি করা যেত। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, টাকার বিনিময়ে সময় বাড়ানো যায় না। বাড়ালেই বরং সেটি নাজায়েজ হয়ে যাবে। তাই দেখা যায়, সুদি লেনদেনে বেঁধে দেয়া সময় অতিক্রম করলে সুদ বাড়তে থাকে। পক্ষান্তরে বাকিতে পণ্য খরিদ করলে নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করলেও সময় বাড়ার কারণে টাকা বৃদ্ধি করা হয় না। তাছাড়া বাকি বিক্রিতে নগদের তুলনায় বেশি মূল্য নির্ধারণ করাটা যদি কোনো কৌশল না হয় এবং বাস্তব বেচাকেনা হয় অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে মালপত্র বিক্রয় করা উদ্দেশ্য হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে নগদের তুলনায় বাকিতে মূল্য বেশি ধরা সম্পূর্ণরূপে বৈধ। যার বৈধতার ব্যাপারে চার মাজহাবই একমত। সরাসরি কোরআন থেকেও এর বৈধতা প্রমাণিত হয়। মুশরিকরা সুদ হারাম হওয়াকে মানত না। তারা বলত, ‘বেচাকেনা তো সুদের মতোই’। (সূরা বাকারা : ২৭৫)। তাদের বক্তব্য ছিল এ ধরনের যে, বাকিতে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে যদি অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ জায়েজ হয়, তাহলে তো সুদও জায়েজ হওয়ার কথা। কারণ সুদেও তো নির্ধারিত সময়ে মূল্য পরিশোধ করতে না পারার কারণে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যও বাড়ে। তাই বাকিতে বিক্রিতে মূল্য বেশি নির্ধারণ করা গেলে সুদে কেন বেশি টাকা গ্রহণ করা যাবে না? আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বেচাকেনাকে আল্লাহ তায়ালা হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা : বাকারা ২৭৫)। হজরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এই আয়াতের উদ্দেশ্য হলো, যখন কোনো মানুষের আবশ্যকীয়ভাবে আদায় করতে হবে- এমন মাল আদায় করার সময় আসে, তখন সে ঋণদাতার কাছে গিয়ে বলে, আমার সময় বাড়িয়ে দিন, আমি আপনার মাল (মূল্য) বাড়িয়ে দেব, তাহলে তা সুদ হবে। তারা বলে, আমরা বেচাকেনার শুরুতে সময় দেই কিংবা মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে সময় দেই, উভয়টিই বরাবর। সাহাবা, তাবেয়িন ও আইম্মায়ে মুজতাহিদিনও বাকিতে বেশি মূল্যে বেচাকেনা জায়েজ বলেছেন। মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাতে আছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে একথা বলতে অসুবিধা নেই যে, নগদ হলে এত দাম আর বাকিতে হলে এত দাম। তবে উভয়ের সন্তুষ্টির ভিত্তিতেই হতে হবে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৬/১১৯-১২১, হাদিস নং ৪৯৪)। হজরত তাউস ও আতা (রহ.) বলেন, ‘একথা বলতে অসুবিধা নেই যে, এ কাপড় নগদে এত আর বাকিতে এত। এর যে কোনো একটি গ্রহণ করতে পারবে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৬/১১৯-১২১, হাদিস নং ৫০০)।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়