মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী:
একজন শ্রমিকের যেহেতু কোনো অর্থবল নেই, তাই আজ শ্রমিকদের অবস্থা সামাজিক মর্যাদায় হীন হয়ে পড়েছে। ইসলাম এসেছে মানুষকে মানবিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে। বস্তুতান্ত্রিক আদর্শের বিপরীতে ইসলামের দৃষ্টিতে আর্থিক সঙ্গতিই সমাজে স্থান লাভের উপায় নয় বরং প্রত্যেক সৎকর্মশীল পরহেজগার ব্যক্তিই এতে মর্যাদার অত্যুঙ্গ শৃঙ্গে আরোহণ করতে পারেন। তিনি জন্মগত বা পেশাগত দিক থেকে যত নীচুমানেরই হোন না কেন, আপন কর্মের মাধ্যমে সমাজে স্বীয় মর্যাদা লাভের নিশ্চয়তা পান। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতিতে আমরা ইসলামের ইতিহাসে অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাই, একজন সৎকর্মশীল পরহেজগার শ্রমজীবী অনেক উঁচু মর্যাদায় আসীন হয়েছেন। পেশায় শ্রমিক বলে এখানে তার মর্যাদাহানিকর কোনো পরিস্থিতি নেই। ইসলাম তার মর্যাদা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সংরক্ষিত করেছে। আমরা জানি, নবী করিম (সা.) একজন শ্রমজীবী ছিলেন। অনেক দিন তিনি নিজের শ্রম বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভের অংশীদার হিসেবে অর্থাৎ মুজারাবাতের ভিত্তিতে হজরত খাদিজা (রা.) এর ব্যবসায় খেটেছেন। তাঁর মতো একজন বিত্তহীনের গলায় সততা ও প্রজ্ঞার সম্যক পরিচয় পেয়েই খাদিজার মতো বড় পুঁজির অধিকারিণী এক মহীয়সী নারী মালা পরিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
শ্রমিক আলী (রা.)
হজরত আলী (রা.) নিজে তার মেহনতি জিন্দেগির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলতেন, মদিনায় থাকাকালীন একবার ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে শহরতলির দিকে কাজের তালাশে বের হয়ে পড়লাম। এক স্থানে একটি মেয়েকে মাটি জমা করতে দেখতে পেলাম। মনে হলো সে হয়তো মাটি ভিজাবে। তখন একেকটি খেজুরের বিনিময়ে একেক বালতি পানি কূপ থেকে তুলে দেয়ার কাজ করলাম। পর্যায়ক্রমে ১৬ বালতি পানি তুললাম। এতে আমার হাতে ফোসকা পড়ে গেল। কাজ সেরে হাত-মুখ ধুলাম। মেয়েটি আমাকে ১৬টি খোরমা পারিশ্রমিক দিয়ে দিল। তা নিয়ে নবী করিম (সা.) এর কাছে এলাম। সবিস্তার ওই ঘটনা বর্ণনা করার পর নবী করিমও (সা.) আমার সঙ্গে তা খেলেন।
শ্রমিক ওমর (রা.)
ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) একজন রাখাল শ্রমিক ছিলেন। মক্কার অদূরবর্তী কাদিদ থেকে ১০ মাইল দূরে জানজান ময়দানে তাকে উট চরাতে হতো। খেলাফতের পর একবার এ মাঠ দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন। পূর্বস্মৃতি জেগে উঠল, চোখে পানি নেমে এলো। সঙ্গীদের তখন নিজের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, এমন এক সময় ছিল যখন ঘোড়ার জিনের মামুলি এক টুকরো কাপড় পরে এ মাঠে আমি উট চরাতাম। পরিশ্রান্ত হয়ে বসে পড়লে বাবা বেদমভাবে প্রহার করতেন। আর আজ, আল্লাহ ছাড়া আমার ওপর কেউ হাকিম নেই।
শ্রমিক আবু হুরায়রা (রা.)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) ছিলেন শ্রমজীবী সাহাবাদের অন্যতম। মদিনায় দরবারে নববিতে হিজরত করে চলে আসার পর একটি মেয়ের বাসায় থাকতেন। শ্রমের বিনিময়ে তাকে জীবিকা চালাতে হতো। তিনি নিজে বলেন, আমি বুছরা বিনতে গাজওয়ানের ঘরে খাবার এবং এক জোড়া জুতার বিনিময়ে কাজ করতাম। তারা উটে আরোহণ করলে তা হাঁকিয়ে নিয়ে যেতাম এবং নেমে এলে তাদের খেদমত করতাম। একদিন আমাকে ওই মেয়ে আদেশ করল, খালি পায়ে নেমে যাও, আবার উট দাঁড়ানো রেখেই এতে উঠে বস। অর্থাৎ জুতা পরার এবং উট বসানোর সময়টুকুও দিত না। আল্লাহর অসীম কুদরত দেখ, আজ ওই মেয়েই আমার অর্ধাঙ্গিনী বলে পরিচিত। বিয়ের পর একদিন তাকে (রসিকতা করে) বললাম, জুতা না পরে এবং উট না বসিয়েই এতে চড়ে বস। দেখুন এর চেয়ে বেশি আর সামাজিক সাম্য কী হতে পারে, একজন মেহনতি তারই মালিককে অনায়াসে বিয়ে করে নিতে পারে। অহেতুক আভিজাত্যের অহমিকা যেখানে কোনো বাধারই সৃষ্টি করতে পারে না। ইসলাম একেক শ্রমজীবীর জন্যও অফুরন্ত সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তার জীবনে পরিমেয় সুযোগ এনে দিয়েছে।
শ্রমিক বেলাল (রা.)
একবার দরবারে নববিতে হজরত ওমর (রা.) এর জবান থেকে বের হয়ে পড়ল, বেলাল, তুমি কাল এক হাবশি। এ শুনে নবী করিম (সা.) বললেন, ওমর এখনও তোমার মধ্যে জাহিলিয়াতের অন্ধ আভিজাত্যের গন্ধ রয়ে গেছে। হজরত ওমর অনুশোচনায় মাটিতে শুয়ে পড়লেন। উঠতে বলা হলে বললেন, বেলাল আমাকে পা দিয়ে তুলে না দেয়া পর্যন্ত আমি উঠব না। শেষে সত্যই তিনি বেলালকে বাধ্য করলেন তাকে পা দিয়ে উঠিয়ে দিতে। একবার আবুজর (রা.) এর সঙ্গে হজরত বেলালের মনোমালিন্য ঘটেছিল। আবুজর আরবের অভিজাত গোত্র গিফারের সরদার ছিলেন। তিনি নিজেকে হজরত বেলাল (রা.) অপেক্ষা কিছুটা উচ্চ বংশজাত মনে করেছিলেন। নবী করিম (সা.) যখন একথা শুনলেন তখন আবুজরকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, তুমি একে গালি দিয়েছ? তিনি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলেন। ছোট করে বললেন, হ্যাঁ। তার মার নাম জড়িত করে গালি দিয়েছ? আবুজর অপরাধ স্বীকার করলেন। এরপর অধীন খাদেমদের পরম নির্ভরস্থল মুহাম্মদ (সা.) বললেন, আবুজর তোমার গোঁয়ার্তুমি এখনও যায়নি। নবী করিম (সা.) সঙ্গে সঙ্গে এদের প্রকৃত মর্যাদার দিকে ইঙ্গিত করে এরশাদ করলেন, আবুজর, এরা (নীচ নয়) তোমাদের ভাই, তোমাদের খেদমত করছে।
শ্রমিক ইকরামা (রা.)
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর আজাদকৃত দাস শ্রমিক ইকরামা (রা.) যখন বসরা যান, তখনকার অবস্থান বর্ণনা করে আইয়ুব সিকতিয়ানি বলেন, মানুষ ইকরামাকে একটু দেখার আশায় এভাবে ভেঙে পড়েছিল যে, অনেকে ঘরের ছাদে পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। ইসলাম সামাজিক আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিকের ব্যবধান দূর করেছে, এমনকি নামগত পার্থক্যও দূর করে দিয়েছে। শ্রমিকদের মর্যাদাহানিকর কোনো শব্দ ব্যবহার ইসলাম বরদাশত করেনি। কোনো দাস শ্রমিককে দাস বলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আরবের প্রচলিত ভাষা ছিল, মালিককে রব বা প্রতিপালক বলা যাবে না। কারণ এতে তার মনে অহঙ্কার এবং সে যে শ্রমিকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ ধারণার জন্ম হতে পারে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ দাস শ্রমিককে 'দাস' বলে ডাকতে পারবে না। আর মালিককেও 'রব' বলতে পারবে না। কারণ তোমরা সবাই গোলাম। একমাত্র আল্লাহই সবার রব বা প্রতিপালক।
লেখক : খতিব-বায়তুল কারিম জামে মসজিদ
হালিশহর, চট্টগ্রাম
খবর বিভাগঃ
ইসলাম
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়