মুহাম্মাদ রাশিদুল হক:
ইসলাম সবধরনের বৈষম্য অস্বীকার করে, 'মানুষ কেউ কারও দাসও নয় আবার প্রভুও নয়। সব মানুষ সমান, এক আল্লাহর দাস এবং আদমের সন্তান। আর আদম মাটির তৈরি।' শ্রম-ইতিহাসে ইসলামই প্রথম শ্রমিকের প্রতি যথার্থ দৃষ্টিপাত করেছে, দিয়েছে সম্মান, মর্যাদা এবং শ্রমের যথাযথ স্বীকৃতি। ইসলাম সমাজের আর ১০ সদস্যের মতো নাগরিক হিসেবে তাদের প্রাকৃতিক অধিকারগুলোর যেমন স্বীকৃতি দিয়েছে, তেমনি শ্রমিক হিসেবে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে অনেক মূলনীতি ও বিধিও প্রবর্তন করেছে। যেন সামাজিক সাম্য বজায় থাকে এবং উভয় জীবনে মৌলিক সফলতা নিশ্চিত হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম হলো উপার্জনের পবিত্রতম মাধ্যম। হালালপন্থায় শ্রমদান ইসলামের দৃষ্টিতে মর্যাদাপূর্ণ একটি বিষয়। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, 'মানুষের স্বহস্তে উপার্জিত খাবারের চেয়ে উত্তম খাবার কিছুই হতে পারে না। নিশ্চয় আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) স্বহস্তে উপার্জন দিয়ে আহার করতেন।' (বোখারি)। হালাল যে কোনো শ্রম সাপেক্ষে উপার্জিত আয়কে সর্বোত্তম উপার্জন আখ্যায়িত করে ইসলাম শ্রম এবং শ্রমজীবী মানুষকে যথাযথ মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছে। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মানবম-লী নবীদের দ্বারা সমাজের দৃষ্টিতে নিম্নমানের শ্রমগুলো সম্পাদন করিয়েছেন। যেন তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, কোনো শ্রমই ঘৃণার চোখে দেখার নয়। শ্রমকে তুচ্ছ করার প্রবণতা নিছক সমাজের ভুল ধারণা। এ ধারণা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
শুধু শ্রমিক নয়, একজন ক্রীতদাসের প্রতিও যেন ঘৃণাবোধ সৃষ্টি না হয় এজন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তায়ালা তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তির অধীনে তার কোনো ভাই রয়েছে সে যেন নিজের আহার্য থেকে তাকে আহার করায় এবং নিজের পরিধেয় থেকে তাকে পরিধান করায়।' (বোখারি : কিতাবুল ঈমান)। হাদিসে বোঝানো হয়েছে, দুই ভাইয়ের মধ্যে যেমন বর্ণবৈষম্যের কোনো প্রশ্নই উঠে না, ঠিক তেমনি শ্রমিক-মালিকের মধ্যেও কোনোরূপ বৈষম্যের প্রশ্ন উঠতে পারে না। খাদ্য-বস্ত্রের দিক দিয়েও যেন ভৃত্য বা শ্রমিককে সমপর্যায়ের রাখা হয় সে হেদায়েতও প্রদান করা হয়েছে এ হাদিসে।
হাদিসের বর্ণনায় পাওয়া যায়, হজরত জাকারিয়া (আ.) কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। হজরত দাউদ (আ.) নিয়োজিত ছিলেন কামারের পেশায়। আর প্রিয়নবী রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও মেষ চরিয়ে শ্রমের মর্যাদাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। এমনকি মানুষের কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট যে কাজ জুতা সেলাই করা, তিনি নিজ হাতে তা করে এহেন শ্রমের প্রতি সমাজের অহেতুক ঘৃণাবোধকে সমূলে উৎপাটন করতে চেষ্টা করেছেন।
শ্রমিকের ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে ইসলামের রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। কাজে নিয়োগ করার আগেই শ্রমের ধরন ও পারিশ্রমিকের পরিমাণ নির্ধারণ করার বিষয়টি সেগুলোর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, 'রাসুলুল্লাহ (সা.) পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে শ্রমিককে শ্রমে নিয়োগ করতে নিষেধ করেছেন।' আরও এরশাদ হচ্ছে, 'শ্রমে নিয়োগ করার সময় শ্রমিককে পারিশ্রমিকের পরিমাণ জানিয়ে দাও।' (নাসায়ি)।
শ্রমিক যেন যথার্থ মজুরি পায় সেজন্য রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, 'শ্রমিক যখন তার কাজ শেষ করবে তখন তার পারিশ্রমিক পরিপূর্ণ করে দিতে হবে।' (মুসনাদে আহমাদ)। শ্রমিক যেন নিজের পারিশ্রমিক হাতে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরূপ টালবাহানা ও অহেতুক বিলম্বের শিকার না হয় সে বিষয়ের প্রতি মালিক পক্ষকে সতর্ক করে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, 'পাওনা পরিশোধে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের টালবাহানা জুলুমের নামান্তর। শ্রমিকের গায়ের ঘাম শোকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।' (বায়হাকি, ইবনে মাজাহ)।
শ্রমিককে যেন তার সাধ্যাতীত কোনো কাজে নিয়োগ না দেয়া হয় সে প্রসঙ্গেও রয়েছে নবীজির মূল্যবান নির্দেশনা। এরশাদ হচ্ছে, 'আর যে কাজ শ্রমিকের সাধ্যাতীত তা করতে তাকে বাধ্য করা যাবে না। যদি সাধ্যাতীত কোনো কাজে তাকে নিয়োগ করা হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন।' (বোখারি : কিতাবুল ঈমান)। এক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা নিজেও শ্রমিককে সহযোগিতা করতে পারে। এতে শ্রম যত কষ্টকরই হোক না কেন তা করতে গিয়ে শ্রমিক মানসিকভাবে আহত হয় না।
শ্রম নির্বাচনের স্বাধীনতা শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক। তাই ইসলাম শ্রমিককে এ স্বাধীনতাও প্রদান করেছে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, 'যখন নামাজ শেষ হয় তখন ভূপৃষ্ঠে বিচরণ করে কর্মে আত্মনিয়োগ করো।' (সূরা জুমা)। শ্রমিক যেন জীবনভর শ্রমিকই না থাকে; তার আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটে, সে উদ্দেশ্যে ইসলাম শ্রমিককে মালিকের সঙ্গে যৌথ কারবারেরও সুযোগ করে দিয়েছে। মুদারাবা জাতীয় পন্থায় শ্রমিক-মালিকের যৌথ কারবারের মাধ্যমে উলি্লখিত সুযোগটি ফলপ্রসূ হতে পারে। ইসলাম শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে প্রভু ও দাসের সম্পর্কের পরিবর্তে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছে। এজন্য মালিককে বলা হয়েছে, 'তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তায়ালা তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং খাওয়া-পরায় যেন তোমাদের মধ্যে সাম্য রক্ষা পায়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করো।'
এ ব্যাপারে হজরত আবু মাসুদ আনসারি (রা). নিজের জীবনের একটি ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, 'একদিন আমি নিজের ক্রীতদাসকে মারধর করছিলাম। এমন সময় পেছনের দিক থেকে আওয়াজ এলো হে আবু মাসুদ! জেনে রাখো, আল্লাহ তোমার চেয়ে অধিক শক্তিশালী। আমি মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখি স্বয়ং রাসুল (সা.) আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমি এ ক্রীতদাসকে আজাদ করে দিলাম।' রাসুল (সা.) বললেন, 'তুমি এমনটি না করলে দোজখের আগুন তোমাকে ঝলসে দিত।'
খবর বিভাগঃ
ইসলাম
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়