Saturday, May 2

নবী-রাসূলদের শ্রম জীবন


মুফতি মাহবুবুর রহমান: যুগে যুগে দেশে দেশে শ্রমিক তার সামাজিক মর্যাদা ও যথাযোগ্য অধিকার থেকে হয়েছে বঞ্চিত। এমনকি আজকের কিছু শিক্ষিত সমাজও শ্রমকে অত্যন্ত হীনকর্ম হিসেবে জ্ঞান করে থাকে। পুঁজির মালিককে অভিজাত শ্রেণীর আর শ্রমের মালিককে নিম্নশ্রেণীর মনে করা হয়। ইসলাম এ কৃত্রিম আভিজাত্যবোধ ও সামাজিক বৈষম্যের বেদিমূলে কুঠারাঘাত করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, 'মানুষের স্বহস্তে উপার্জিত খাবার সর্বোত্তম খাবার। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) স্বহস্তে উপার্জন করে আহার করতেন।' (বোখারি)। আদি মানব আদম (আ.) চাষাবাদ করেছেন। নুহ (আ.) ও জাকারিয়া (আ.) কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। ইদ্রিস (আ.) দর্জি, দাউদ (আ.) কর্মকার আর মুসা (আ.) রাখাল ছিলেন। এমনকি বিশ্বনবী (সা.) নিজেও রাখালি করে শ্রমিকের প্রতি সমাজের অহেতুক ঘৃণাবোধকে সমূলে উৎখাত করে দিয়েছেন। ইসলাম এসেছে মানুষকে মানবিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে। ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা শ্রমিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা, সামাজিক মর্যাদা এবং ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করেছে। শ্রমিক নির্যাতন ও শোষণের সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক প্রভু-ভৃত্যের পরিবর্তে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে উন্নীত করেছে। এ মর্মে প্রিয়নবী (সা.) বলেন, 'তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং যার কোনো ভাইকে তার অধীন করে দেয়া হয়েছে, সে নিজে যা আহার করবে তাকেও যেন তা আহার করতে দেয় এবং সে নিজে যা পরিধান করবে তাকেও যেন তা পরিধান করতে দেয়া হয়। আর তাকে এমন কাজ করতে বাধ্য করবে না যাতে সে পর্যুদস্ত হয়ে পড়বে। এমন কঠিন কাজে বাধ্য করা হলে তাকে যেন সহযোগিতা করে।' (বোখারি)। এ হাদিসে শ্রমিকের যথাযোগ্য মর্যাদা ও অধিকার চিত্রায়ণ করা হয়েছে। শ্রমিকের মর্যাদাকে মালিকের সমমর্যাদায় বিভূষিত করা হয়েছে। শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের কথা বলে আভিজাত্যের পর্দা তুলে দেয়া হয়েছে। শ্রমিক ও মালিকের মাঝে বর্ণবৈষম্য দূর করা হয়েছে। শ্রমিকের খাবার, বাসস্থান ও পোশাক-আশাক কিরূপ হবে এবং তার ওপর কী পরিমাণ কাজের ভার অর্পণ করা যাবে তাও ব্যক্ত করা হয়েছে উপরোক্ত হাদিসে। মজুরি ও পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো পরিমাণ নির্ধারিত করে না দিলেও উপরোক্ত হাদিসে এর ইঙ্গিত রয়েছে। অর্থাৎ পুঁজিদাতার সমমানের হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্তত মানুষ হিসেবে জীবনধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন সে পরিমাণ মজুরি অবশ্যই তাকে দেয়া কর্তব্য। রাসুল (সা.) বলেন, 'শ্রমিক যখন তার কাজ সমাপ্ত করবে তখন তার পারিশ্রমিক পূর্ণমাত্রায় আদায় করবে।' (মুসনাদে আহমদ)। সাহাবি আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, 'রাসুল (সা.) শ্রমিকের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কখনোই জুলুম করতেন না।' (বোখারি)। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, 'শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক আদায় করে দাও।' (ইবনে মাজাহ)। এক্ষেত্রে কোনো টালবাহানা ইসলাম অনুমোদন করে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'বিত্তবানদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অন্যের পাওনা পরিশোধে টালবাহানা করা জুলুম বা অন্যায়।' (বোখারি ও মুসলিম)। ইসলাম শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে প্রভু ও দাসের সম্পর্কের পরিবর্তে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছে। একজন ভালো মালিক শ্রমিকের প্রতি কী ধরনের মনোভাব প্রদর্শন করবে তা সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে শুয়াইব (আ.) এর ভাষায়। মুসা (আ.) অনেক দিন পর্যন্ত শুয়াইব (আ.) এর কাছে গতর খেটে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তাকে নিয়োগ করার সময় তিনি বলেছিলেন, 'আমি তোমার ওপর কষ্টের বোঝা চাপিয়ে দিতে চাই না। ইনশাআল্লাহ তুমি আমাকে সদাচারী হিসেবেই দেখতে পাবে।' (সূরা কাসাস : ২৭)। এ আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়, মালিককে সজ্জন ও সহনশীল হতে হবে। শ্রমিকদের প্রতি ক্ষমাসুন্দর মনোভাব পোষণ করতে হবে। হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, একদা জনৈক সাহাবি নবী (সা.) কে জিজ্ঞেস করেন, 'হে আল্লাহর রাসুল! চাকর, খাদেমদের অপরাধ কতবার ক্ষমা করব? নবীজি শুনে চুপ রইলেন। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ব্যাকুল হয়ে বললেন, প্রত্যেক দিন ৭০ বার হলেও তাকে ক্ষমা করে দিও।' আজকের পুঁজিপতিরা সামান্য ত্রুটির জন্য শ্রমিক ছাঁটাই, চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকি এমনকি জরিমানা হিসেবে বেতনের টাকা পর্যন্ত কর্তন করে রাখে। শ্রমিক শোষণের নানা পথ ও পন্থা উদ্ভাবন করে সেগুলোকে আইনের পোশাক পরিয়ে রেখেছে। আনাস (রা.) বলেন, 'আমাকে একদিন রাসুল (সা.) কোনো এক কাজে পাঠালেন। আমি ওই কাজে রওনা হয়ে পথে ছেলেদের সঙ্গে খেলায় লেগে গেলাম। সহসা নবীজি কোথা থেকে এসে আমাকে ধরে ফেললেন। কিন্তু তিনি আমার প্রতি রুষ্ট হননি এবং আমাকে ভর্ৎসনাও করেননি। তিনি আরও বলেন, 'আমি ১০ বছর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর খেদমত করেছি। কিন্তু তিনি কোনো দিন আমাকে বলেননি, এটা এভাবে কেন করেছ, ওটা ওইভাবে কেন করনি।' (শামায়েলে তিরমিজি)। ইসলাম শুধু মালিককেই শ্রমিকের সঙ্গে সদাচার, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার কথা বলেনি বরং শ্রমিককেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছে। মালিক তার পুঁজি ও মেধা ব্যয় করে, লাভ-লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে কর্মের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলেই শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়েছে। অতএব, মালিকের এ অবদানের কথা স্মরণ রেখেই শ্রমিককে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে এবং মালিকের সম্পদ সংরক্ষণের ব্যাপারে যত্মবান হতে হবে। পবিত্র কোরআনে উত্তম শ্রমিকের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে, 'আপনার চাকর হিসেবে সেই উত্তম যে শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত।' (সূরা কাসাস : ২৬)। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, 'যে শ্রমিক মালিকের কল্যাণকামী হয় তার উপার্জন সর্বশ্রেষ্ঠ।' (শরহে বোখারি)। সুতরাং শ্রমিকের কর্তব্য হলো, মালিকের কল্যাণ কামনার মানসিকতা নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা। মালিকের সম্পদের হেফাজত করা। মালিককে ধোঁকা দিলে বা কাজে ফাঁকি দিলে কিংবা তার সম্পদ বিনষ্ট করলে কেয়ামত দিবসে আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। এরশাদ হয়েছে, 'অবশ্যই তোমাদের কাজের ব্যাপারে তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে।' (সূরা নাহল : ৯৩)। মোটকথা, ইসলাম শ্রমিককে যেমন তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করেছে, তেমনি মালিককেও তার কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে দিয়েছে। মালিকের সদাচার, সহানুভূতি, কল্যাণকামিতার মানসিকতা, আর শ্রমিকের শ্রমদানের নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা ও মালিকের প্রতি কল্যাণকামিতার মানসিকতার ফলে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ গড়ে উঠবে। লেখক : মোহাদ্দিস জামেয়া উসমানিয়া সাতাইশ, গাজীপুর

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়