Tuesday, May 5

নিজের পেটে নিজেই অস্ত্রোপচার!


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: সাল ১৯৬১, সে সময় চিকিৎসা ব্যবস্থা কি আজকের মতো এমন উন্নত ছিল? তাও যদি হয় বরফাচ্ছাদিত অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের কোনো এক দুর্গম অঞ্চল? অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হলেও বাস্তবেই এক ব্যক্তি নিজেই নিজের পেটে ছুরি-কাঁচি চালিয়েছিলেন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পেটের অ্যাপেন্ডিকসটি ফেলে দেয়ার জন্য! ১৯৬১ সালে অ্যান্টার্কটিকার মতো জায়গায় নিরুপায় হয়ে কাজটি করলেও তা সফলও হয়েছিল দারুণ! পেশায় চিকিৎসক ও নাগরিকত্বে রুশ লিওনিড রোগোজভ কাজের সূত্রে অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ করছিলেন, ভ্রমণকালীনই হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাৎক্ষণিক অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। অথচ প্রত্যন্ত অঞ্চলটিতে যে দলের সাথে কাজে গিয়েছিলেন তিনি, সে দলে তিনিই ছিলেন একমাত্র চিকিৎসক। ফলে খুব সহজেই বুঝে নিলেন, নিজেই কাজটি না করলে প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে যেতে দেরি নেই। মানবদেহের একটি অভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গ অ্যাপেন্ডিকস। ইংরেজি ‘অ্যাপেন্ডিকস’ শব্দটির বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘অবশিষ্ট’। মানবদেহের ক্ষেত্রেও একই অর্থ কিছুটা খাটে বৈকি! এটি এমন একটি প্রত্যঙ্গ, যার বাস্তবে তেমন কোনো কার্যকারিতা নেই। কিন্তু কোনো কারণে যদি এতে কোনো ধরনের ক্ষত বা জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে, তবে তা অবিলম্বে অস্ত্রোপচার করে ফেলে না দিলে অ্যাপেন্ডিকসটি ফেটে যায় এবং তৎক্ষণাৎ মৃত্যু নিশ্চিত। এখনকার দিনে একজন শল্যবিদের জন্য অ্যাপেন্ডিকসে সমস্যার তীব্রতা অর্থাৎ অ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগটি শনাক্ত করা কোনো ব্যাপারই নয়। এখনকার সভ্যজগতে এই রোগে অস্ত্রোপচার এখন শল্য চিকিৎসকদের প্রাত্যাহিক কাজে পরিণত হয়েছে। সেই ৫০ বছর আগে ২৭ বছর বয়স্ক তরুণ চিকিৎসক লিওনিড রোগোজভও অ্যাপেন্ডিকসে আক্রান্ত হওয়ার আগেই এই রোগেরই অসংখ্য অস্ত্রোপচার করে রীতিমতো দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। তবে সেদিন সভ্য জগতের ভেতরে নয়, বাইরে অ্যান্টার্কটিকার এক মানববিহীন অঞ্চলে ছিলেন তিনি। অ্যান্টার্কটিকার ওই অঞ্চল আজও কেবল একগাদা বরফের স্তূপ, মানবসভ্যতার কোনো নামগন্ধই নেই সেখানে। সেদিনকার সেই শল্য চিকিৎসক লিওনিড নিজেই নিজের অ্যাপেন্ডিসাইটিসের সমস্যা সহজে ধরে ফেলতে পারলেও অস্ত্রোপচার কি নিজেই নিজেরটা করা সহজ ছিল? মোটেই না! কিন্তু জীবন বাঁচাতে রোগাক্রান্ত দুর্বল মানুষটির এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চল পরিদর্শনে যাওয়া ষষ্ঠ রুশ দলের ১২ সদস্যের একজন ছিলেন লিওনিড। গবেষক দলটির ওপর যে কাজের ভার দিয়ে পাঠানো হয়েছিল, তা শেষ করে ফেরার আগে অ্যান্টার্কটিকার প্রবল শীতের সময়টি সবে ‘উপভোগ’ করতে শুরু করেছিলেন তারা। আর সে সময়েই দলের একমাত্র চিকিৎসকটিই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। এপ্রিল মাসের শেষ সময়ে তার অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়ে পড়ে যে মৃত্যুর আশঙ্কাতেই পড়ে যায় তার জীবন। সে সময় অ্যান্টার্কটিকা থেকে সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে রাশিয়া পৌঁছাতে ৩৬ দিন সময় লাগতো, যা লিওনিডের হাতে ছিল না। আর রাশিয়া থেকে পরের জাহাজটির রওনা দেয়ার কথা আরো এক বছর পর। আজকের মতো সে সময় মোবাইলে বা ফোনে যোগাযোগের ব্যবস্থাও ছিল না যে লিওনিডের অবস্থা ব্যাখ্যা করে সাহায্য বা চিকিৎসক দল চেয়ে পাঠানো হবে। এর ফলে নিজেই নিজের অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিলেন লিওনিড। নিজেরই হাতে নিজের পেট কেটে বের করে আনলেন ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। দলের দুই সদস্যকে নিজের সহকারীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন রোগী ও চিকিৎসক লিওনিড- কাটাকুটির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এগিয়ে দেয়া, আলো ধরা এবং আয়না ধরে পেটের অবস্থা দেখতে সাহায্য করার জন্য। এছাড়া বাকিরাও নানারকম সাহায্য করেছিল সেদিন। লিওনিডের সেদিনকার সহকর্মীরা জানান, পুরো সময় জুড়ে ভীষণ নিখুঁত চিকিৎসকের আচরণই করে গিয়েছিলেন লিওনিড। এমনকি অস্ত্রোপচারের মধ্যপথে যখন জ্ঞান হারাচ্ছিলেন বা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলেন, তাও সবাইকে জানিয়ে তবেই জ্ঞান হারাচ্ছিলেন! অস্ত্রোপচার শেষে তার অ্যাড্রেনালিন গ্রন্থিতে সূঁচ ফুটিয়ে কিভাবে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হবে, তাও সহকর্মীদের দেখিয়ে দিয়েছিলেন! এ ধরনের রোগে অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীকে পুরোপুরি অচেতন করে নিতে হয়। কিন্তু রোগী নিজেই যেখানে নিজের চিকিৎসক, সেখানে অবশ্যই সে প্রশ্ন ওঠারই ব্যাপার নেই। ব্যথা টের না পেতে তাই দেহের নির্দিষ্ট অংশেই শুধু চেতনানাশক ঔষধ ব্যবহার করেছিলেন লিওনিড। আর চেতনানাশক ব্যবহার করায় সাধারণ রোগীর মতো চেতনা হারাতে বসলেও ক্ষণে ক্ষণেই একজন পেশাদার চিকিৎসকের মতো জেগে উঠে ফের হাতও চালিয়েছিলেন! প্রতি চার-পাঁচ মিনিট পরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। অস্ত্রোপচারের শেষ ও সবচেয়ে কঠিন পর্যায়ে এসে আর হাত চলছিল না লিওনিডের, পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলেন তিনি। তবে কেবল ইচ্ছেশক্তির জোরে ফের জেগে উঠে শেষ পর্যন্ত পেট থেকে অ্যাপেন্ডিকস বের করেন তিনি, এরপর নিজের ক্ষততে সেলাইও করে দেন। সেই ইচ্ছেশক্তি নাকি ফিরে পেয়েছিলেন সাদা পোশাক পরিহিত মুখ ঢাকা সহকর্মীদের দিকে তাকিয়ে, যারা লিওনিডকে কিছুতেই মৃত্যুর হাতে পড়তে দিতে চাইছিলেন না- কিন্তু লিওনিডকে বাঁচানোর উপায়ও জানতেন না। ভয় লিওনিডও পেয়েছিলেন ভীষণরকম! তাও ভয়কে জয় করেই নিজের প্রাণ নিজেই বাঁচিয়ে তোলেন তিনি। অস্ত্রোপচার শেষে সহকর্মীদের সবকিছু জীবাণুমুক্ত করার নির্দেশনাও দিচ্ছিলেন লিওনিড! অস্ত্রোপচার শেষ হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যে লিওনিড জানতেনই না যে কোনো মানুষের পক্ষে তার নিজের তলপেট খুলে ফেলে ভেতরে ‘জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি’ করে আবারো তা সেলাই করা আদৌ সম্ভব কিনা, অস্ত্রোপচার শেষে সেই তিনিই বুঝতে পারলেন- করে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি! প্রচুর রক্ত, দেহের ভেতরে ঘন, কালচে, আঠালো রক্ত দেখতে অভ্যস্ত লিওনিডের জন্য সেদিনকার পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা মানুষ মাত্রই অনুমেয়। সেলাই ও চিকিৎসকের প্রয়োজনীয় সব কাজ সেরে তবেই অস্ত্রোপচার পরবর্তী ঘুমে ঢলে পড়েছিলেন লিওনিড, কাজে যোগ দিয়েছিলেন দু’ সপ্তাহ পরই। ২০০০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা লিওনিড রোগোজভ পুরো অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করে গিয়েছেন নিজের লেখা ডায়েরিতে। সুত্র:বিবিসি

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়