Monday, May 4

এখনই সতর্ক হোন


কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক: ২৫ এপ্রিল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প হয়েছে। প্রায় মিনিটখানেক স্থায়ী থাকে সে কম্পন। ইউএসজিএসের (মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর) তথ্য বলছে, ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৯। উৎপত্তিস্থল নেপালের পোখরা। ভূমিকম্প একযোগে কাঁপিয়েছে ভারত-নেপাল ও বাংলাদেশকে। রোববার দুপুরেও বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সতর্ক করেন, যাতে তারা অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর পথে ফিরে আসে। চলুন দেখি কোরআন ও সহিহ হাদিস অনুযায়ী ভূমিকম্পের কারণ অনুসন্ধান এবং এ থেকে কীভাবে আমরা বাঁচতে পারি তার উপায় বের করি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(আসলে) আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই।’ (সূরা ইসরা : ৫৯)। ‘অচিরেই আমি আমার (কুদরতের) নিদর্শনগুলো দিগন্ত বলয়ে প্রদর্শন করব এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও (তা আমি দেখিয়ে দেব), যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের ওপর এটি পরিষ্কার হয়ে যায়, এ (কোরআনই মূলত) সত্য; একথা কি যথেষ্ট নয় যে, তোমার মালিক সবকিছু সম্পর্কে অবহিত? (সূরা হা-মিম সিজদাহ : ৫৩)। ‘বল, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর, তোমাদের ওপর (আসমান থেকে) অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম, অথবা তিনি তোমাদের দল-উপদলে বিভক্ত করে একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে সক্ষম।’ (সূরা আনআম : ৬৫)। বোখারি শরিফের বর্ণনায় জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যখন ‘তোমাদের ওপর থেকে (আসমান থেকে)’ নাজিল হলো তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি তোমার সম্মুখ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি’, অথবা যখন, ‘অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম’ নাজিল হলো, তখন তিনি (সা.) বললেন, ‘আমি তোমার সম্মুখ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (বোখারি : ৫/১৯৩)। (আবুল-শায়খ আল-ইস্পাহানি এ আয়াতের তফসিরে বর্ণনা করেন, ‘বল, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর, তোমাদের ওপর থেকে (আসমান থেকে)’ যার ব্যাখ্যা হলো, তীব্র শব্দ, পাথর অথবা ঝড়ো হাওয়া; ‘অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম’, যার ব্যাখ্যা হলো, ভূমিকম্প এবং ভূমিধসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া।) নিঃসন্দেহে বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প ঘটছে তা মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শনগুলোর একটি, যা দিয়ে তিনি তাঁর বান্দাদের ভয় দেখিয়ে থাকেন। এ ভূমিকম্প এবং অন্যান্য দুর্যোগ সংঘটিত হওয়ার ফলে অনেক ক্ষতি হচ্ছে, অনেকে মারা যাচ্ছেন এবং আহত হচ্ছেন। এ দুর্যোগ আসার কারণ হচ্ছে, শিরকি কার্যকলাপ (ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে মহান আল্লাহর অংশীদার বানানো) এবং মানুষের পাপ (মহান আল্লাহ যে কাজগুলো করতে নিষেধ করেছেন সে কাজগুলো করার কারণে)। এক্ষেত্রে মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে মানুষ) যে বিপদাপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই এবং (তা সত্ত্বেও) আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অনেক (অপরাধ এমনিই) ক্ষমা করে দেন।’ (সূরা শুরা : ৩০)। ‘যে কল্যাণই তুমি লাভ করো না কেন, মনে রেখো, তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, আর যেটুকু অকল্যাণ তোমার ওপর আসে তা আসে তোমার নিজের থেকে।’ (সূরা নিসা : ৭৯)। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে ওঠার অনুমতি দেন, যার ফলে তখন বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুষ্ঠিত হয়। এটি মানুষকে ভীত করে, তারা মহান আল্লাহর কাছে তওবা করে, পাপ কাজ করা ছেড়ে দেয়, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এবং তাদের কৃত পাপ কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়।’ আগেকার যুগে যখন ভূমিকম্প হতো তখন সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকেরা বলতেন, ‘মহান আল্লাহ তোমাদের সতর্ক করছেন।’ মদিনায় যখন একবার ভূমিকম্প হয়েছিল, তখন ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তার জনগণকে ভাষণে বললেন, ‘যদি আরও একবার ভূমিকম্প সংঘটিত হয় তাহলে আমি এখানে তোমাদের সঙ্গে থাকব না।’ যখন কোথাও ভূমিকম্প সংঘটিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন মানুষের উচিত মহান আল্লাহর কাছে অতি দ্রুত তওবা করা, তাঁর কাছে নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা, মহান আল্লাহকে অধিক হারে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা, যেভাবে রাসুল (সা.) সূর্য গ্রহণ দেখলে বলতেন, ‘যদি তুমি এরকম কিছু দেখে থাক, তখন দ্রুততার সঙ্গে মহান আল্লাহকে স্মরণ করো, তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো।’ (বোখারি : ২/৩০)। দরিদ্র ও মিসকিনদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা এবং তাদের দান করা উচিত, কারণ রাসুল (সা.) বলেন, ‘দয়া প্রদর্শন করো, তোমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে।’ (আহমদ : ২/১৬৫)। ‘যারা দয়া প্রদর্শন করে মহান দয়াশীল আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া দেখাবেন। পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো, এবং বেহেশতে যিনি আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন।’ (তিরমিজি : ৬/৪৩)। ‘যারা দয়া প্রদর্শন করবে না তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে না।’ (মুসলিম, ৪/১৮০৯)। যখন কোনো ভূমিকম্প সংঘটিত হতো, ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) তার গভর্নরদের দান করার কথা লিখে চিঠি লিখতেন। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যা মানুষকে বিপর্যয় (আজাব) থেকে নিরাপদে রাখবে, তা হলো- যারা ক্ষমতায় আছে (অর্থাৎ যারা দেশ পরিচালনা করছে) তাদের উচিত দ্রুততার সঙ্গে সমাজে প্রচলিত অন্যায় থামিয়ে দেয়া, তাদের শরিয়া আইন মেনে চলতে বাধ্য করা এবং সে অনুযায়ী চলা, ভালো কাজের আদেশ দেয়া এবং খারাপ কাজে নিষেধ করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘মোমিন পুরুষ ও মোমিন নারীরা হচ্ছে একে অপরের বন্ধু। এরা (মানুষের) ন্যায় কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত আদায় করে, (জীবনের সব কাজে) আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসুলে (বিধানের) অনুসরণ করে, এরাই হচ্ছে সেসব মানুষ, যাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা অচিরেই দয়া করবেন। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা পরাক্রমশালী, কুশলী।’ (সূরা তওবা : ৭১)। দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের অপরিকল্পিত অবকাঠামো সবচেয়ে বেশি দায়ী। তারপর আরও বড় কথা হচ্ছে ইন্সিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম আমাদের দেশে নেই। যদি কখনও এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়, কাদের নেতৃত্বে এ ধরনের সিস্টেম পরিচালিত হবে, সে বিষয়েও ঠিকমতো নির্দেশনার অভাব রয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান যেমন রাজউক, সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানে লোকবল বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মহড়ার আয়োজন করা উচিত। তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক অন্যায়-অনাচার রোধে ধর্মীয় অনুশাসনের যথার্থ অনুশীলন করা। আর ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তওবার প্রতি বেশি বেশি মনোনিবেশ করা। বাংলাদেশ যে শুধু ভূমিকম্পের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ, তা কিন্তু নয়। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে, সাইক্লোনজনিত ঝড়ের ফলে প্রায়ই বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেয়। পাশাপাশি প্রতি বছর বন্যায় বেশ কিছু পরিমাণ আর্থিক ও জানমালের ক্ষতিসাধিত হয়ে থাকে। আর সরকারের পাশাপাশি নীতিনির্ধারক মহল থেকে এ বিষয়ে আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এখন আমাদের খুবই আন্তরিকভাবে মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা উচিত, আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট একমাত্র দ্বীন ইসলামকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং আল্লাহ তায়ালা যেসব শিরকি কার্যকলাপ ও পাপ কাজ করতে নিষেধ করেছেন (যেমন- নামাজ পরিত্যাগ না করা, জাকাত আদায় করা থেকে বিরত না হওয়া, সুদ-ঘুষ না খাওয়া, মদ না পান করা, ব্যভিচার না করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা না করা, গান ও বাদ্যযন্ত্র না শোনা, হারাম কাজগুলো ভঙ্গ না করা প্রভৃতি) তা থেকে বিরত থাকা। লেখক : শিক্ষক নাজিরহাট বড় মাদরাসা, চট্টগ্রাম

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়