Tuesday, May 5

পাখির নাম গাঙচষা


ফরিদী নুমানঃ ধারণা করেছিলাম পাখিটা বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু না আছে। তথ্যটা প্রথমে মুস্তাফিজ মামুন ভাই দিয়েছিলেন। আমরা নিঝুম দ্বীপ যাচ্ছি শুনে বললেন এখানকার দমার চরে স্কিমার বা গাঙচষা পাখিটি পাওয়া যায়। এটি দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। ঝাঁক ঝাঁক হরিণ দেখার স্বপ্ন নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম নিঝুম দ্বীপে। প্রথম দিন সন্ধ্যায় এখানকার বন্দরটিলা থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার হাঁটাপথে নামার বাজার ছেড়ে চৌধুরীর খালের পাড়ে ঝোঁপের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকলাম। এর আগে প্রায় সাত বছর আগে এখানে বসেই হাজার হাজার হরিণ দেখেছিলাম। হাজার কেন একটা হরিণও আমরা সেখানে পেলাম না। এ হতাশা নিয়ে রাতে বন্দরটিলায় হোটেলে ফিরে এলাম। একটা বোট ঠিক করলাম- সারাদিনের জন্য। সূর্য যখন উঠি উঠি করছে- আমরা ততক্ষণে সকালের নাশতা প্রায় শেষ করে ফেলেছি। বন্দরটিলা বাজার থেকে প্রায় কিলোমিটারের পথ মাড়িয়ে পুবের ঘাট থেকে আমাদের বোটে উঠলাম। মনের মধ্যে শিহরণ- পাব তো পাখিটাকে! পথে অবশ্য দেশি কিংবা পরিযায়ী বেশকিছু পাখির দেখা মিলল। ওগুলোতে আজ আর মন ভরছে না। নদীতে সবে জোয়ারের যৌবনযাত্রা শুরু হয়েছে। আধঘণ্টা নৌকার একটানা ভটভটি শব্দ হজম করে জনমানবহীন একটা চরে সুবিধামতো স্থানে আমরা থামলাম। বোটচালক বলল এটাই দমার চর। কিন্তু সুবিধা হলো না। বোট থেকে নেমে হাঁটু কাদা মাড়িয়ে চরের উঁচু স্থানে থামলাম। এখানে ছোট ছোট ঘাস। ঘাসগুলো এতটাই ধারালো আর তীক্ষ্ণ যে তার নির্মম আঘাতে আমাদের সবার পা-ই কমবেশি কেটেকুটে গেল। বাধ্য হয়ে নদী তীরবর্তী এলাকায় ফিরে এলাম। ঠিক এ সময় আমাদের প্রিয়দর্শিনীর দেখা পেলাম। নদীর পানিতে তার অদ্ভুত ঠোঁট ডুবিয়ে উড়ে যাচ্ছে একজোড়া গাঙচষা। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে চিৎকার করে বললাম- আরে এই তো- এই তো। একবার নয় দুবার নয়, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক তার সামনেই নদীর পানি চিরে বার উড়ে যাচ্ছে গাঙচষাদ্বয়। মাঝে মাঝে ক্যাপ ক্যাপ ক্যাপ করে অস্ফুট শব্দও করছে। মনে হচ্ছে আমাদের দেখানোর জন্যই বারবার ঘুরেফিরে একই জায়গা থেকে তাদের কাজ শুরু করছে। পাখি দুটো একেবারে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে দেখছিলাম তাদের অদ্ভুত কর্মকাণ্ড। পরে ফিওে এলাম বোটে। মাঝিকে বললাম সামনের দিকে যেতে। বোট এগিয়ে চলল। সামনে নানান জাতের ঝাঁক ঝাঁক পাখি। হঠাৎ খেয়াল করলাম ডান দিকের চরের ওপর গাঙচষাদের বিশাল এক ঝাঁক। আমাদের বোট ধিরে ধিরে এগিয়ে চলল সেদিকে। বোটের শব্দে একসময় পাখিগুলো উড়তে শুরু করল। তাদের ছন্দময় ওড়াওড়ি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম আর ছবি তুলতে থাকলাম। চরের ওপর দিয়ে, নদীর পানির উপর দিয়ে উড়তে উড়তে এক সময় মাথার উপর উড়ে দূর দিগন্তে চলে গেল ওরা। IMG 1102 2 বর্ণনা নাম দেশি গাঙচষা হলেও পাখিটি পানিকাটা নামেও পরিচিত। এর কারণ হলো খাবারের খোঁজে এরা পানিতে নিচের চঞ্চু ডুবিয়ে একধার থেকে আরেকধারে উড়ে বেড়ায়। বৈজ্ঞানিক নাম : জুহপযড়ঢ়ং ধষনরপড়ষষরং, আর ইংরেজিতে বলে : ওহফরধহ ঝশরসসবৎ। গত কয়েক বছরে তাদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে এবং বর্তমানেও হ্রাস পাচ্ছে। সে কারণে আইইউসিএন এই প্রজাতিকে সংকটাপন্ন বলে ঘোষণা করেছে। পৃথিবীতে মোট প্রাপ্তবয়স্ক দেশি গাঙচষার সংখ্যা আনুমানিক ৪,০০০ থেকে ৬,৭০০টি বলে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল দাবি করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পাখিটির দৈর্ঘ্য কমবেশি ৪০ সেন্টিমিটার, ডানা ৩৭ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৭.৭ সেন্টিমিটার, পা ২.৫ সেন্টিমিটার আর লেজ ১০.৮ সেন্টিমিটার। প্রজনন ঋতুতে প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ কালচে-বাদামি রঙ ধারণ করে। দেহতল চকচকে সাদা। মাথার চাঁদি কালো, কপাল ও গলাবন্ধ সাদা। ঘাড়ের পেছন দিক, কাঁধ ঢাকনি, ডানা ও লেজের উপরিভাগ কালো। লেজতল ও ডানার মধ্য-পালকের আগা সাদা। ডানার পালকতল-ঢাকনিও সাদা। চোখ বাদামি। ঠোঁট লম্বা ও আকার ছুরির মতো। ঠোঁটের গোড়া উজ্জ্বল লাল। আগা হলুদ। এদের ঠোঁট অন্যসব পাখির ঠোঁটের মতো না। উপরের চঞ্চু নিচের চঞ্চুর তুলনায় খাটো। শিকার ধরার সুবিধার্থে এদের ঠোঁটের এমন আজব গড়ন। ভারত ও পাকিস্তানে গাঙচষা সারা বছর থাকে এবং দেশ দুটি এদের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র। শীতকালে বাংলাদেশে দেশি গাঙচষার বিশাল ঝাঁক দেখা যায়। এ সময়ে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা-মোক্তারিয়া চ্যানেলে মোহনায় দমারচরের কাঁদাচরে তাদের সবচেয়ে বড় দলটি বিচরণ করে। নেপালে খুব কম সংখ্যায় দেখা যায়। মিয়ানমারেও খুব কম সংখ্যায় এরা টিকে আছে। অথচ একসময় সারা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইন্দোচীনের মেকং নদ পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি ছিল। সম্প্রতি কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওসে কোনো গাঙচষা দেখা যায়নি। সম্ভবত এরা দেশগুলো থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিশেষত চর এবং বালুচরই গাঙচষাদের আবাসভ‚মি। এখানেই তাদের প্রজনন হয়। বালুর মধ্যে ডিম পাড়ে। আর এটাই এদের বংশবিস্তারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চর এলাকায় মানুষের বসতি বেড়ে গেছে। সাথে সাথে চরগুলো গো-মহিষের চারণভ‚মি হয়ে ওঠায় তাদের উৎপাতে এদের ডিম ও বাচ্চা ব্যাপক হারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর তাই বাড়ছে তাদের বিলুপ্তির আশঙ্কা।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়