গোলাম মাওলা রনি:
শিরোনামের কাহিনীটি বড়ই অদ্ভূত এবং বাঙালীর ভবিষ্যৎ রুচিবোধের জন্য একটি অশনি সংকেত। ঘটনার দিন ছিল ৩০ এপ্রিল। অফিসে বসে কাজ করছিলাম। হঠাৎ মোবাইলে একটি ফোন এলো। অপর প্রান্ত থেকে মেয়েলী কন্ঠে জনৈক যুবক বললো- ভাই আমি লালবাগ থেকে বলছি। জীবনের প্রথম ভোটটি আপনাকে দিলাম- কিন্তু আপনি তো জামানত হারাইলেন। যুবকের কথা বলার ধরন দেখে আমি অনুমান করলাম যে, সে আমাকে টিটকারী মেরে আনন্দ লাভ করতে চাচ্ছে। আমি সতর্ক হয়ে তার পরবর্তী বানীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। সে আবার বললো- আগামীতে আমাদের ওয়ার্ডে কমিশনার পদে দাড়াইয়েন - ভোট দেবো। আমি বললাম আচ্ছা । যুবক বললো ভাই কুত্তা মার্কায় দাড়াইয়েন। আমি বললাম- আপনার আব্বা এবং আম্মাকে বলেন আগামীতে কুত্তা এবং শুয়োর প্রতীক বরাদ্ধের ব্যবস্থা নিতে। যুবক কি বুঝলো জানিনা ফোন রেখে দিলো।
২৮ এপ্রিল ২০১৫ সালের নির্বাচন নামক ছোটদের কার্টুন বা পাপেট শো দেখার পর আমি ভাবছিলাম- দুষ্টবুদ্ধিতে কে বড়- শয়তান নাকি মানুষ ! যুবকের কথা শুনে আমি কুকুর প্রতীকের সম্ভাব্য ভোটারদেরকে নিয়েও ভাবনা শুরু করলাম। তখন মনে হলো এই প্রহসনের নেপথ্য কাহিনী সম্পর্কে আমার কিছু বলা উচিত। আমি প্রার্থী হবার পর সরকারী দল থেকে কোন হুমকী-ধামকী, বাধা বিপত্তি না এলেও বিরোধী দল থেকে অনেক প্রস্তাব পাই। আমি বিনয়ের সঙ্গে সকল প্রস্তাব ফিরিয়ে দেই এবং নিজের মতো প্রচারণা চালাতে থাকি।
আমি প্রথমেই টার্গেট করি ৪ লাখ ভোটারকে যারা কোন মতেই বিএনপি এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। আমি ব্যক্তিগত যোগাযোগ, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডাতে গিয়ে ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে প্রায় দেড় লাখ লোকের সঙ্গে মত বিনিময় করি। আমার নির্বাচনী এলাকার প্রায় ৫০ হাজার ভোট এবং রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় স্বজনের ৫০ হাজার ভোট টার্গেট করি। পুরান ঢাকার একটি এলাকায় আমার আত্মীয়রা সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে আসছেন, এবারও একজন কমিশনার হয়েছেন ২৬ হাজার ভোট পেয়ে। সেই ভোট এবং তরুণ এবং মহিলাদের ভোট টার্গেট করে আমি কৌশলে প্রচার চালাতে থাকি এবং যথা সময়ে ইতিবাচক সাড়া পাই।
আমি টিভি মিডিয়া পরিহার করেছিলাম এই উদ্দেশ্যে যেনো আমার প্রতিপক্ষরা আমার কৌশল টের না পায়। তারা যদি বুঝতো যে আমি নির্বাচনের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগী তাহলে পদে পদে ঝামেলা সৃষ্টি করতো। আমি আমার পরিকল্পনায় কতটা সফল হয়েছিলাম তা সরকার যেমন টের পেয়েছে তেমনি বিরোধী দলও অনুভব করেছে। দেশের সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতো আমিও বিশ্বাস করতাম যে সরকার নির্বাচনটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠ করবে। সরকার যদি তিনটি সিটেই হারতো তাহলে তাদের উপকার বই অপকার হতো না। কিন্তু সরকারী দল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মারাত্মক অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থায় যেকোন মূল্যে প্রার্থীদেরকে বের করে আনা ছাড়া তাদের কোন বিকল্প ছিল না। আমি এই ঘটনা টের পাই ২২ এপ্রিল বিকেল বেলা যখন আমার কার্যত কিছুই করার ছিলো না। আমি প্রচারণা বন্ধ করে দিই। এবং এজেন্ট নিয়োগ স্থগিত করি। ২৫ তারিখ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে সকল প্রার্থীদেরকে নিয়ে গোল টেবিল বৈঠক ছিলো যা দুইটি সরকার সমর্থক টিভি লাইভ প্রচার করে। ২৩ তারিখ সকালে বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিস থেকে আমার নিকট আমন্ত্রণ আসলে আমি তা ফিরিয়ে দেই এই বলে যে- আমার ওখানে গিয়ে কোন লাভ হবে না। কারণ ফলাফল নির্ধারণ হয়ে আছে- আমার জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। এরই মধ্যে সাইদ খোকনের সঙ্গে আমার একদিন দেখা হলো এবং তাকেও আমি জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা বললাম। সে হাসলো এবং আবদার করলো রনি ভাইয়ের সঙ্গে একটি ছবি তোলার জন্য।
প্রাপ্ত ভোটের ফলাফলে আমার ভোট ১৮৮৭ দেখানো হলেও আমি যে কতভোট পেয়েছি এবং কতভোট পেতাম তা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। দক্ষিণ ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় ভোট গ্রহণ চলেছে মাত্র দুই ঘন্টা । এরই মধ্যে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায়। ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে হয় ফিরে আসেন নয়তো লাঞ্চিত হতে থাকেন। এই দুইঘণ্টার ভোট গ্রহণের পর নির্বাচন কমিশনকে হিসেব মেলানোর জন্য এক লাখ ছাব্বিশ হাজার বৈধ ব্যালট পেপার বাতিল করতে হয়। এর বাইরে সরকারী দলের লোকজন প্রায় আড়াই লাখ ব্যালট ছিড়ে ফেলে। এখন প্রশ্ন হলো বাতিল হওয়া এবং ছিড়ে ফেলা প্রায় পৌনে চার লাখ ভোট কে পেয়েছিলো?
যারা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন তারা ভোটগ্রহণ শুরু হবার পূর্বেই সরকারী প্রার্থী এবং বিএনপি প্রার্থীর ভোট নির্ধারণ করে সিল পিটিয়ে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে রেখেছেন। বাকী ব্যালট নিয়ে নির্বাচন শুরু হবার একঘন্টার মধ্যেই তারা বুঝতে পারেন যে তৃতীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট পড়ছে যা তাদের চিন্তা চেতনা ও গণনার মধ্যে ছিলো না। দ্রুত ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায় এবং নির্বাচনী কেন্দ্রে শুরু হয় উত্তেজনা। ফলে তড়িঘড়ি করে ঘটতে থাকে একটার পর একটা অঘটন। এতো কিছুর পরও তারা হিসেবের খাতায় রেখে যায় হিমালয় পর্বতের মতো মারাত্মক অনিয়মের প্রমাণসমূহ যার বিচার একসময় ইতিহাস অবশ্যই করবে।
সবাই জানে ঢাকাতে আওয়ামী লীগের মোট ভোট মাত্র ৩০%। ঢাকা দক্ষিণে ৩০% হিসেবে তাদের ভোটার মাত্র পাঁচ লাখ ৬০ হাজারের মতো । নির্বাচন কমিশন দেখিয়েছে যে ৪৭% ভোট কাস্টিং হয়েছে। এই হিসেবে সাইদ খোকনের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা হওয়া উচিত ছিলো মাত্র দুই লাখ তেষট্রি হাজার। অথচ তার পক্ষে সিল পেটানো হয়েছে পাঁচ লাখ পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি। অন্যদিকে পাঁচ লাখ পয়ত্রিশ হাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মির্জা আব্বাসের ভোট হয়েছে প্রায় পৌনে চার লাখ।
পরবর্তীতে যখন আরো চার লাখের মতো ভোট পড়ে যায় মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে তখন সংশ্লিষ্টরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। নতুন করে লিখা হয় সংলাপ। তাতে অভিনীত হয় আড়াই লাখ ব্যালট ছেড়ার দৃশ্য এবং এক লাখ ছাব্বিশ হাজার ব্যালট বাতিলের গল্প। সব শেষে মঞ্চায়িত হয় গোলাম মাওলা রনির জামানত হারানোর দৃশ্য।
ইচ্ছে ছিলো কিছু বলবো না। ১৮৮৭ ভোটের ফল নিয়ে নিজেকে আবৃত করে রাখবো এবং প্রতিপক্ষকে আনন্দ করতে দেবো অবাধে। সেমতে ফেইসবুকে গত বৃহস্পতিবার স্টাটাসও দিলাম যা কিনা দেশের প্রধান দৈনিক হুবহু ছাপিয়েছে এবং অনেকগুলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। ফেইসবুকের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারেও স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি শেয়ার এবং লাইক পেয়েছে। কিছু তরুণ বন্ধুর বিরূপ মন্তব্য এবং অন্য বন্ধুদের হতাশ মনোভাব দেখে আমার মনে হলো জাতিকে সত্য কথা জানানো উচিত যদিও মনেপ্রাণে আমি চাইনি যে আমার দল বিব্রত হোক। তারপরও লিখলাম কেবলমাত্র প্রগতিশীল মুক্ত চিন্তার মানুষদের জন্য যারা শত প্রতিকূলতার মাঝেও দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। তাদের জন্য বলছি- গোলাম মাওলা রনি পরাজিত হয়নি বরং প্রচারণার সময়ে সর্বমহলের অকুন্ঠ ভালোবাসা, সমর্থন এবং সহযোগিতা পেয়েছে তার তুলনা হয় না। কাজেই ২৮ এপ্রিলের দূর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে নির্বাচন না মনে করে দুর্ঘটনা মনে করাই উত্তম। আর সেই দুর্ঘটনায় আমরা যারা আহত হয়েছি তারা বড়জোর মর্মাহত হতে পারি- কিন্তু লজ্জিত বা অপমানিত বোধ করার কোন কারণ নেই।
খবর বিভাগঃ
রাজনীতি
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়