অনলাইন ডেস্ক:
নির্জন পাহাড়ি বন। উচ্চতা প্রায় ৬০০ ফুট। চারপাশেই ঘন গাছ-গাছালি। তারই মাঝে হাঁটছি আমরা। কখনও নিচু থেকে উপরে উঠছি, কখনও উপর থেকে নিচে নামছি। আবার কখনও বা পাড়ি দিচ্ছি ছোট্ট ছড়া। আমাদের উদ্দেশ্য জলের শীতল স্পর্শ। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হই, বিশ্রাম নিই, তারপর আবার হাঁটা। এভাবে প্রায় দেড় ঘণ্টা। এক সময় পৌঁছায় জলের সেই শীতল স্পর্শে। এ শীতল জল পুকুর, নদী বা খালের নয়, খোদ পাহাড়ি ঝরনার। আর এ ঝরনার নাম হাম-হাম। এর অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায়। এ ঝরনার জলের শীতল স্পর্শ নিতেই গত বছর ২৫ এপ্রিল গিয়েছিলাম সেখানে।
উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ২৪ এপ্রিল রাত ১১টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে। আসন পেলাম জানালার পাশে। তখন গরমটাও ছিল ভালো। তাই বাইরে থেকে আসা ফুরফুরে বাতাস কিছুটা শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে গরম চা, ভালোই লাগছে। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ট্রেন এসে থামে কুলাউড়া স্টেশনে। নেমে টি-স্টলে হালকা চা-নাশতা সারলাম। তারপর যাত্রীদের বিশ্রামাগারে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। সকাল ৬টার দিকে বড়লেখা থেকে গাড়ি নিয়ে এলো সাজেদ, গুলজার, মাসুম, মাহবুব ও জামিল। এর মধ্যে সাজেদ আমার পূর্বপরিচিত। বাকিরা সাজেদের বন্ধু। আমরা সবাই নাশতা খেলাম কুলাউড়ার একটি রেস্টুরেন্টে। তারপর শুরু হলো আমাদের যাত্রা। গাড়ির চালক গুলজার। গাড়িটিও তার।
আমরা প্রথমে আসি কমলগঞ্জ উপজেলা সদরে। এখান থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে হাম-হামের অবস্থান। কমলগঞ্জ থেকে আদমপুর বাজার হয়ে আমরা এগিয়ে চলি হাম-হামের দিকে। দুইপাশে সারি সারি চা বাগান আর আঁকাবাঁকা মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে আমরা এলাম চাম্পারায় চা বাগানে। এ পর্যন্ত পথটুকু ভালোই ছিল। গাড়িও চলছিল দারুণ। কিন্তু এখান থেকে শুরু হয়েছে মাটির পথ। গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত নয়। তবুও আমাদের গাড়ির চালক গুলজার আস্তে আস্তে চালিয়ে চলল। আমরা কুরমা বন বিটের কুরমা চা-বাগান পাড়ি দিয়ে এলাম কলাবন গ্রামে। কুমরা বন বিট রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একটি। কলাবন গ্রামটি আদিবাসী চা শ্রমিকদের।
কলাবন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী কয়েকজন তরুণ-যুবক আমাদের ঘিরে ধরল। মূলত তারা হাম-হামের গাইড। আমরা বিকাশ নামে এক যুবককে নিলাম গাইড হিসেবে। সঙ্গে আরও ছিল টমি নামের একটি কুকুর। কুকুরটি বিকাশের পরিচিত। আর স্থানীয় কিশোরদের কাছ থেকে আমরা ছয়জন ছয়টা বাঁশের চলা কিনলাম। তারপর সবাই হাফপ্যান্ট, টি-শার্ট পরে আর সঙ্গে বোতল ভর্তি পানি ও স্যালাইন নিয়ে রওনা হলাম আমাদের গন্তব্যে।হাম হাম ঝরনা
প্রচন্ড গরমের মধ্যেই আমরা হাঁটছি। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে দলের অন্য সদস্যদের কষ্টই হচ্ছিল। কেউ কেউ তো কষ্টের ভয়ে ফিরেও যেতে চেয়েছিল। এভাবে প্রায় দেড় ঘণ্টায় প্রায় ছয় কিলোমিটার পথ হেঁটে হেঁটে অবশেষে এলাম ঝরনার ছড়ায়। যে ছড়ায় ঝরনার পানি প্রবাহিত হয়ে চলেছে। ছড়ায় এসেইে সাজেদ আর মাসুম শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ এখানে বসে থেকে ছড়া ধরেই রওনা হলাম ঝরনার উদ্দেশে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা দেখতে পেলাম হাম-হামের আসল রূপ। সত্যিই ঝরনাটি দারুণ। ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী এলাকা ঘেঁষা এ ঝরনাটির উচ্চতা হবে ১৬০ থেকে ১৭০ফুট। ২০১০ সালের দিকে এটি আবিষ্কার করে বাংলাদেশের একদল পর্যটক।
সবাই ঝরনার পানিতে গোসল করলাম। ঝরনার নিচে একটি চায়ের দোকান আছে। আমরা সেখানে চা-বিস্কুট খেলাম। বেশ কিছুক্ষণ ছিলাম ঝরনার নিচে। তারপর ফেরার পালা। গাইড বলল অন্য রাস্তা দিয়ে গেলে পাহাড় পাড়ি দিতে হবে না। তার কথা মতো ফেরার সময় অন্যপথ ধরলাম। ফেরার সময় পাহাড় পাড়ি দিতে হলো কম, তবে পথ কম নয়, আর এ পথে রোমাঞ্চটাও ছিল একটু বেশি। কারণ এ পথটি ঝরনারই ছড়াপথ। মাঝখানে ছড়া আর দুইপাশে পাহাড়, ভালোই রোমাঞ্চকর। সবার কাছেই উপভোগ্য ছিল। তবে এ পথের পানির ছড়াগুলোয় জোঁকের উপদ্রব ছিল অনেক। দলের সবাইকে জোঁকে ধরেছে, আমি ছাড়া।
ফিরতে ফিরতে বেলা প্রায় শেষ। কলাবন থেকে রওনা দিয়ে এলাম আদমপুর। সেখানের একটি রেস্টুরেন্টে খেলাম দুপুরের খাবার। তারপর রওনা হলাম কুলউড়ার উদ্দেশে। পথে থামলাম শমসেরনগর বধ্যভূমি ও সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে। মুক্তিযুদ্ধের এ স্মৃতিস্তম্ভে কিছুক্ষণ কাটালাম। তারপর আবার গাড়িতে উঠলাম। থামলাম বড়লেখার আজিমগঞ্জ বাজারে এসে। এটা নাজমুলের গ্রাম। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাতে রতুলী বাজার থেকে শ্যামলী বাসে উঠলাম ঢাকার উদ্দেশে।
প্রয়োজনীয় তথ্য : সায়েদাবাদ এবং ফকিরাপুল থেকে শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, বড়লেখার বাস ছেড়ে যায় সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। ভাড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এছাড় কমলাপুর থেকে উপবন এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন ট্রেন যায় সকাল ও রাতে। ভাড়া ২৪৫ থেকে ২৭৫ টাকা। কমলগঞ্জ বা শ্রীমঙ্গল থেকে অটোরিকশায় বা ভাড়া করা গাড়িতে যাওয়া যাবে চাম্মারায় চা বাগান এবং কলাবন গ্রাম পর্যন্ত। সেখান থেকে হেঁটেই যেতে হবে হাম-হাম।
লেখক : গাজী মুনছুর আজিজ
খবর বিভাগঃ
দর্শনীয় স্থান
ফিচার
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়