Monday, April 13

পোড়া মরিচ থেকে পান্তা-ইলিশ


মোঃ মাহমুদুর রহমান: মানব সভ্যতার ইতিহাস- অগ্রগতির ইতিহাস। গুহাবাসী উলঙ্গ মানুষ সময়ের বিবর্তনের আজ স্যুটেড-বুটেড, জ্ঞান-বিজ্ঞানে শাণিত সভ্য মানুষ। সবই হয়েছে প্রয়োজন আর অগ্রগতির অণে¦ষায় তাড়িত চিন্তাশক্তি ও পরিশ্রমের ফলে। এমনই এক প্রয়োজনের তাগিদে ১৫৮৪ সালে মোগল সম্রাট আকবরের নির্দেশে ফতেউল্লাহ সিরাজী প্রবর্তন করেন বাংলা সন। সম্রাট আকবরের ক্ষমতারোহণের স্মৃতিকে অমলিন রাখার জন্য ১৫৫৬ সাল থেকে কার্যকর করা হয় এই সন। বাংলা সাল যখন প্রবর্তন করা হয় তখনও এদেশে ইংরেজি ও হিজরি সন প্রচলিত ছিল। রাজকার্যে হিজরি সনকেই প্রধান্য দেয়া হতো। হিজরি সন প্রতিবছর ১০ দিন এগিয়ে আসার কারণে সাম্রাজ্যের খাজনা আদায়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে জমির খাজনা দিতে মানুষের সুবিধা হয় ফসলী মওসুমে। কৃষক যখন ঘরে ধান তুলে তখন তাঁর পক্ষে খাজনা দেয়া এবং শাসকদের পক্ষে খাজনা তোলা যত সহজ, ততখানিই কঠিন অন্য সময়ে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়। প্রথম দিকে বাংলা সনকে ফসলী সনও বলা হতো। এই ফসলী সন বা বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ যা ইংরেজি ১৪ এপ্রিল শুরু হয়। তাই প্রচলনের সময় বাংলা সনের প্রধান টার্গেট ছিল কৃষি ও কৃষক। ব্যবসায়ীরাও বাংলা সন ব্যবহার করতেন। ‘হালখাতা‘ শব্দটি পহেলা বৈশাখকে উপলক্ষ্য করে বহুল প্রচলিত বাঙ্গালীদের মধ্যে। চৈত্র মাসে পুরোনো বছরের হিসাব শেষ করে পহেলা বৈশাখে হিসাবের খাতাকে হালনাগাদ করার জন্যই হালখাতা শব্দটি ব্যবহার করা হতো। এই কয়েক দশক আগেও প্রত্যেক দোকানিই হালখাতা উৎসব পালন করতেন। বিচ্ছিন্নভাবে অতীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বা অন্য কোন ঘটনায় পহেলা বৈশাখ পালনের উল্লেখ থাকলেও ব্যাপকভাবে ‘শুভ হালখাতা‘ নাম দিয়ে দিবসটি পালন করা হতো। চৈত্র মাস এলেই বিভিন্ন দোকানে হালখাতার তারিখ সম্বলিত নানা রঙের ফেস্টুন দেখা যেতো। নির্দিষ্ট দিনে মিষ্টি বিতরণ ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকতো। বর্তমানে ইংরেজি বর্ষের দাপটে পহেলা বৈশাখের সাথে সম্পর্কিত হালখাতা উৎসবটি জৌলুসহীন হয়ে পড়েছে। এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না। তবে বাংলা সন এখনও আমাদের কৃষি ও কৃষকের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। কোন মাসে কিসের চারা রোপণ করতে হবে, কখন ফসল উঠবে- এসবই বাংলা মাসের সাথে সম্পর্কিত। কৃষক এখনও জানে চৈত্র মাসে ধানচাষের প্রস্তুতি নিতে হয়। বৈশাখে বীজতলায় ধানের চারার জন্য ধানবীজ রোপণ করতে হয়। আউশ ধানের জন্য জৈষ্ঠ্য মাসে চারা রোপণ করতে হবে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে পাকা ধান ঘরে উঠবে। আবার দু‘ফসলি জমিতে শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে আমন ধানের চারা লাগাতে হয়। অগ্রহায়ণ মাসে পাকা ধানে ক্ষেতের মাঠ ও কৃষকের উঠোন মৌ মৌ গন্ধে ভরে যায় কৃষকের মন। তারপর শীতকালীন শাকসব্জি চাষ। এসবের কোনো কিছুতেই ইংরেজি মাসের নাম বললে কৃষক তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। কারণ কৃষির সাথে বাংলা মাসগুলো এমনভাবে জড়িয়ে আছে তা যেকোনো অবস্থায় আলাদা করা কঠিন। এই কৃষকের দিনের কর্মসূচী শুরু হয় ভোর রাতে। কৃষক হালের গরু ও লাঙ্গল নিয়ে মাঠে যাবে। এর আগে ব্যস্ত কিষাণী কৃষকের খাবার বন্দোবস্ত নিয়ে। কিষাণী ব্যস্ত হলেও আয়োজন অতি সাধারণ। রাতের খাবারের পর থাকা ঠান্ডা ভাত যার মধ্যে পানি দিয়ে বানানো পান্তাভাত, সাথে চুলার আগুনে পোড়ানো শুকনো লংকা মরিচ । খুব বেশী আয়োজন হলে সাথে সামান্য আলু ভর্তা। কৃষক লবণ মিশিয়ে মহা আনন্দে খাবার শেষ করে কোমরে বা মাথায় গামছা, কাঁধে লাঙল, হাতে বাশের কঞ্চি আর সামনে হালের গরু হাঁকিয়ে মাঠের দিকে যাত্রা শুরু করে। এভাবেই একসময় শুরু হতো আমাদের দেশের সনাতন কৃষকের কর্মব্যস্ত দিন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এরাই অন্ন তুলে দেয় ১৬ কোটি মানুষের মুখে। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও সম্মান জানাতে প্রতিবছর উৎসবের আমেজে পালন করি পহেলা বৈশাখ। গ্রামে গঞ্জে বসে বৈশাখী মেলা। ভোররাতে কৃষকের হালচাষে যাওয়ার খাবার হিসেবে পান্তাভাতও খেয়ে থাকি। ইদানিং আমাদের পহেলা বৈশাখে উৎসবের মেজাজে এসেছে পরিবর্তন। ব্যবসায়ীরা সুযোগটি হাতছাড়া করেনি। বৈশাখী পোষাকে সয়লাব মার্কেটগুলো। সবাই কেনাকাটায় ব্যস্ত অনেকটা ঈদের মতো। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী রঙ্গীন পোষাক কিনছেন পহেলা বৈশাখে পরার জন্য। পহেলা বৈশাখে সারা দেশ উৎসবের আমেজে রঙ্গীন হয়ে ওঠে। সত্যিই এক অপরূপ দৃশ্য ধারণ করে আমাদের এই শ্যামল বাংলা। কেউ কেউ একে বাড়াবাড়ি কিংবা বাঙ্গালীর অতি আবেগ হিসেবে দেখলেও এসব নির্দোষ বাড়াবাড়ি নিয়ে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। উৎসবপ্রিয় বাঙ্গালীরা যার যার মতো দিনটি পালন করেন। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন। সংস্কৃতিকর্মীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্টান পরিবেশন করে থাকেন। অন্যরা তা উপভোগ করেন। উৎসবের আদলে পরিবর্তনের ফাঁকে রসনা বিলাসী বাঙ্গালীরা পোড়ামরিচ-পান্তাভাতের জায়গায় নিয়ে এসেছে পান্তা-ইলিশ। এতে একদিকে আমাদের নতুন প্রজন্ম কৃষকের প্রকৃত জীবনচিত্র থেকে দূরে থাকছে, অন্যদিকে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশের উপর অতিরিক্ত চাহিদাজনিত চাপ আসছে। এ অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে গিয়ে আপাতত ইলিশের দাম বাড়ছে কয়েকগুন। দীর্ঘমেয়াদে আমরা ইলিশ মাছের বংশ নির্মূলের ঝুঁকিও সৃষ্টি করছি। বৈশাখের আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত অন্য বিষয়গুলোর সরবরাহ ইচ্ছে মতো হ্রাস-বৃদ্ধি করা সম্ভব। বৈশাখী সাদা-লাল পোষাক যত ইচ্ছা তত কারখানায় অর্ডার দিয়ে তৈরী করে নেয়া যায়। কিন্তু ইলিশের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। ইলিশ এমন একটি মাছ যা ফার্মেও চাষ করা যায় না। দিন দিন এমনিই বঙ্গোপসাগরে ইলিশের উপস্থিতি হ্রাস পাচ্ছে। বছরের নির্দিষ্ট সময় মা ইলিশ ধরা বন্ধ করে এবং জাটকা নিধন নিষিদ্ধ করে সরকার ইলিশের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। দেশের মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য সরকার ইলিশ রফতানিও বন্ধ রেখেছে। কিন্তু আমরা যদি পহেলা বৈশাখের মতো জাতীয় উৎসবে ইলিশকে আবশ্যিক উপাদান হিসেবে গ্রহন করি তাহলে জাটকা নিধন বন্ধ করা যাবে না। পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে যেখানে ইলিশের হালি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে সেখানে জাটকারও চাহিদা থাকবে এবং জেলেরাও জাটকা ধরবে। এছাড়া আর্থিকভাবে দূর্বল যারা হাজার হাজার টাকা দিয়ে ইলিশ কিনতে পারবে না তাদের ভরসা হিসেবে থাকবে জাটকা। এভাবে ১৬ কোটি মানুষের সম্মিলিত হামলার মুখে ইলিশ কতদিন তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে- তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। আমাদের সরকার ও মিডিয়া বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করলে ভালো হয়। মিডিয়ার প্রচারণার সুবাদে আমরা যেমন পোড়া-মরিচ থেকে পান্তা-ইলিশে পৌঁছেছি, তেমনি আবার শেকড়ে ফিরে আসতে হবে। নতুবা আমাদের উৎসবের মেজাজের বর্তমান অগ্রগতি ইলিশ সম্পদের প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে নিয়ে আসতে পারে দুর্গতি। পোড়া-মরিচ আর পান্তা-ভাত ছেড়ে আমরা বিস্মৃত হচ্ছি বাংলার কৃষকের আসল রূপ। পান্তা-ইলিশের উৎসবের মাধ্যমে জাতীয় মাছ ইলিশের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছি। আদি ও অকৃত্রিম বাংলার কৃষককে তুলে ধরার জন্য এবং ইলিশ মাছ রক্ষার প্রয়োজনে আমাদের উৎসবের রসনা বিলাসে একটু পরিবর্তন আনতে হবে। সবাইকে ফিরে আসতে হবে পোড়া মরিচ আর পান্তা ভাতে। লেখক: ব্যাংকার ও কলাম লেখক

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়