Thursday, April 30

কালামুখ প্যারাপাখি


ফরিদী নুমানঃ ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সপরিবারে আবারো সুন্দরবন যাই। ২৩ ফেব্রুয়ারি আমাদের যাত্রার শেষদিন ভোরে হারবাড়িয়া খাল দিয়ে জাহাজ ধীরে-ধীরে চলছিল। ফারুক ভাই বললেন এ খালে দুষ্প্রাপ্য একটা হাঁস পাওয়া যায়, যেটা সুন্দরবনের আর কোথাও পাওয়া যায় না। আমি ক্যামেরা নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম এবং পেয়ে গেলাম কথিত সেই দুষ্প্রাপ্য হাঁসপাখিকে। কিন্তু পাখিটি হাঁস তো নয়ই, তার নিকটাত্মীয়ও নয়; বরং সারস, কালেম, কুট ও পানমুরগির ঘনিষ্ঠজন। ওই বিভ্রান্তিকর নাম ব্যবহার না করে বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ একে ‘প্যারাপাখি’ নামকরণ করেছে। কারণ পাখিটি মূলত প্যারাবনেই বাস করে। সুন্দরবনের বাঘ যেমন রহস্যময় তেমনি রহস্যময় এই ‘কালামুখ প্যারাপাখি’। ইংরেজিতে বলা হয় গধংশবফ Masked Finfoot. কিন্তু সুন্দরবনের জেলে ও বাওয়ালি একে বলে ‘হাঁসপাখি’, কেউ নাম দিয়েছে ‘গইলো হাঁস’। পৃথিবীতে মাত্র দুই জাতের প্যারাপাখি আছে, ‘কালামুখ প্যারাপাখি’ ও ‘আফ্রিকার প্যারাপাখি’। বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনাম পর্যন্ত সাতটি দেশের মুষ্টিমেয় কটি বাদা এলাকায় কালামুখ প্যারাপাখি টিকে আছে। সারা পৃথিবীতে কেবল গুটিকতক স্থানে এ পাখিরা বসবাস করে। বর্তমানে সুন্দরবনই সম্ভবত পাখিটির বৃহত্তম আবাস। পৃথিবীর মাত্র ৩৩ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এদের বিস্তৃতি। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে ক্রমেই কমছে এবং এদের পূর্ববর্তী কয়েকটি বিচরণস্থলে সম্ভবত এরা বিলুপ্ত। সে কারণে আইইউসিএন প্রজাতিটিকে বিপন্ন বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। পৃথিবীতে মোট কালোমুখ প্যারাপাখির সংখ্যা আনুমানিক ৬০০ থেকে ১৭০০টি বলে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল উল্লেখ করেছে। আবার আরেকটি হিসাবে প্রজাতিটির সদস্য সংখ্যা ১০০০-এর কম বলে ধারণা করা হয়েছে। প্যারাপাখি দূর থেকে দেখে সহজেই হাঁস বলে ভুল হতে পারে; আকারে-প্রকারে পাতিহাঁসের সঙ্গে এর কিছু মিল আছে। তবে এর বিশাল হলুদ ঠোঁট বেশ চোখা, হাঁসের মতো চেপ্টা নয়। এর লম্বাটে সবুজ পায়ের প্রতিটি আঙুলে বিচ্ছিন্ন পর্দা আছে, হাঁসের মতো পর্দা দিয়ে আঙুলগুলো জোড়া নয়। ছেলে ও মেয়ে প্যারাপাখির আকার ও রঙে পার্থক্য আছে। মেয়ের চেয়ে ছেলে বড়। মেয়ের ওজন আধা কেজির কম, ছেলের ওজন পৌনে এক কেজি। মেয়ের গলার পালক সাদা, ছেলের ঘন কালো।
কাদামাটিতে হেঁটে অথবা তীরসংলগ্ন পানিতে সাঁতার কেটে প্যারাপাখি মাছ, মাডিস্কপার, চিংড়ি ও পোকা শিকার করে। মানুষ দেখলে প্যারাপাখি খুব দ্রুত পানিতে দেহ ডুবিয়ে ফেলে অথবা বনের মধ্যে গা ঢাকা দেয়। বাঘের মতো নিভৃতচারী এ পাখি কখনো দলবেঁধে বাস করে না, একাকী বিচরণ করে এবং কেবল প্রজননের সময় জোড়া বাঁধে। পানির কাছে ঝুঁকে থাকা গাছের সমান্তরাল ডালে পাতা দিয়ে বাসা বানিয়ে বর্ষাকালে প্যারাপাখি চার-ছয়টি ডিম দেয়। বাঘের মতো প্যারাপাখিকেও সুন্দরবন ছাড়া বাংলাদেশে আর কোথাও দেখা যায় না। এ দেশে বাঘের সংখ্যা তবু মোটামুটি জানা আছে, কালামুখ প্যারাপাখির সংখ্যা অজানা। অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের ধারণা, এদেশে বাঘের চেয়েও প্যারাপাখির সংখ্যা কম; পাখিটি চোখে দেখেছেন এমন পাখিবিদের সংখ্যা আরো কম। বাগেরহাট ও খুলনা জেলার সুন্দরবনের দক্ষিণে মানুষের আনাগোনা কম এমন নিভৃত খালের পাড়েই অধিকাংশ প্যারাপাখির বাস; বনের উত্তরে ও পশ্চিমে পাখিটি কমই চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে প্যারাপাখির দেখা একেবারেই মেলে না। পৃথিবীর কোনো চিড়িয়াখানায় কালামুখ প্যারাপাখি নেই। সুন্দরবনের বাঘ গবেষণার মতোই দীর্ঘক্ষণ ধরে প্যারাপাখি পর্যবেক্ষণ করাও দুঃসাধ্য কাজ। ফলে পাখিটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব রয়েছে। ‘তথ্যের অপ্রতুলতার বিচারে কালামুখ প্যারাপাখির মতো পাখি পৃথিবীতে কমই আছে’- এ মন্তব্য করা হয়েছে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল প্রণীত ‘হ্যান্ডবুক অব দ্য বার্ডস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এ। প্যারাপাখির বিচরণভূমির বৈশিষ্ট্য, আহার্য-তালিকা, পূর্বরাগ, প্রজনন-সফলতা ও ছানার জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য এখনো মানুষের অজানা। অদূর ভবিষ্যতে পাখিটির বিলুপ্তি রোধ করার জন্য ওই সব তথ্য সংগ্রহে দেশের দক্ষ গবেষকদের উৎসাহ দেওয়া জরুরি বলে পাখিপ্রেমীরা মনে করেন। এ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহজেই এ বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। সুন্দরবনের অনন্যসাধারণ পাখিটি সংরক্ষণে বন বিভাগেরও বিশেষ উদ্যোগ থাকা উচিত। বৈশ্বিক সংকটাপন্ন এ পাখি রক্ষা করার দায়িত্ব বাংলাদেশের সব পাখিপ্রেমী ও সচেতন মানুষের। তথ্যসূত্র : ইনাম আল হক

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়