Monday, February 2

সরষে ফুল : হলদে শাড়ির অতিথি


জাকির উসমান: মাঠে মাঠে সরষে ফুল। দিগন্তজোড়া হলুদের বিস্তার। গ্রামের চারপাশ ভরে উঠেছে হলুদের ঘ্রাণ আর সৌরভে। এর অনিন্দ্য সৌন্দর্যে ঝলসে উঠেছে প্রকৃতি। কাঁচাসোনা রোদে ঝলমল করছে ফসলি জমি। এ সময় গ্রামবাংলা ছেয়ে যায় সরষে ফুলের নন্দনে। হলুদ সরষে ফুলের অবারিত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় মন। দৃষ্টিরসীমা প্রলম্বিত প্রকৃতির হলুদ অাঁচল বিছানো দিগন্ত দেখে অপার্থিব অনুভূতি তৈরি হয়। মধুর লোভে হলদে ক্ষেতের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় মৌমাছি। কুয়াশা আর শিশির উপেক্ষা করে সরষে ফুলের আলিঙ্গনে জড়ায় মধুপিয়াসী ভ্রমর। গরমকালে যেমন আমের মুকুল, তেমনি শীতকালে সরষে ফুল থেকে মৌচাষিরা পোষা মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করে থাকেন। সরষে ফুল চোখে পড়ে শীতকালজুড়েই। বেলে-দোঅাঁশ মাটিতে এর চাষ। উৎপত্তিস্থল এশিয়া। ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শীতকালীন রবিশস্য হিসেবে এর চাষ করা হয়ে থাকে। সরষে ফুলের জন্য পানি ক্ষতিকর বলে শীত ছাড়া অন্য কোনো সময় এটি দেখা যায় না। এর বৈজ্ঞানিক নাম ব্রাসিকা ক্রুসিফেরি (Brassica Cruciferae)। সরষে তেলপ্রদায়ী দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ। এটি একবর্ষজীবী। একটি সরষে গাছের দৈর্ঘ্য প্রায় ১ মিটার। বীজ বোনার ৮৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে সরষের ফলন ঘরে তোলা যায়। এর জন্য ১২ থেকে ২৫ ডিগ্রি পরিমাণ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। যদিও আমাদের দেশে সরষে চাষের জন্য অপটিমাম তাপমাত্রা নির্ধারিত আছে সর্বোচ্চ ২০ ডিগ্রি এবং সর্বনিম্ন ৫ ডিগ্রি। গড়ে প্রতি হেক্টর জমিতে সরষে পাওয়া যায় ৮৩৭ কেজি। বাংলাদেশে সাধারণত অক্টোবরের প্রথমদিকে সরষে চাষাবাদ শুরু হয়। তবে নভেম্বরজুড়েও কমবেশি এর চাষাবাদ লক্ষ্য করা যায়। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে ঋতুর গড়বড়ের কারণে এখন ডিসেম্বরেও কোথাও কোথাও সরষে চাষ দেখা যায়। ছোট চারাগাছ থেকে একটি পরিপূর্ণ সরষে গাছ হয়ে উঠতে এর সময় লাগে দুই মাস। এ সময় সরষে গাছে এক ধরনের বিবর্ণ রঙের ছোঁয়া লাগে। এরপর সরষে শুষ্ক হয়ে উঠতেই চাষি গাছ কাটার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এটি দুই থেকে তিন দিন রোদে শুকিয়ে দানা বের করতে হয়। এ দানা থেকেই তৈরি করা হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্য। উপকারিতা সরষে দানা মশলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দানা পিষে তৈরি করা তেল রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। এ দানা পানির সঙ্গে মিশিয়ে ভিনেগারসহ বিভিন্ন তরল তৈরি করা হয়। নানা ওষুধ তৈরির কাজেও সরষে খুব দরকারি উদ্ভিদ। সরষে পাতা একটি উপাদেয় শাক। এটি সরিষার শাক বা সরষে শাক হিসেবে পরিচিত। সরষের আবাদ বাড়িয়ে ভোজ্যতেলের ঘাটতি মেটানো সম্ভব। কোরআনে সরষে কোরআনে অনেক জায়গাতেই আল্লাহ তায়ালা সরষের প্রসঙ্গ এনেছেন। এর সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন কাজের তুলনা করেছেন। এর ক্ষুদ্রতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে উদাহরণ দিয়েছেন। দয়াময় আল্লাহ এক জায়গায় বলছেন, '(লোকমান আরও বলল) হে বৎস! যদি (তোমার) কোনো আমল সরষের দানা পরিমাণ (ছোটও) হয় এবং তা যদি কোনো শিলাখন্ডের ভেতর কিংবা আসমানগুলোতেও (লুকিয়ে) থাকে অথবা (যদি তা থাকে) জমিনের ভেতরে থাকে, তা-ও আল্লাহ তায়ালা সামনে এনে হাজির করবেন; আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই সূক্ষ্মদর্শী এবং সব বিষয়ে সম্যক অবগত।' (সূরা লোকমান : ১৬)। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলছেন, 'আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম করা হবে না। যদি কোনো আমল সরষে দানার পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট।' (সূরা আম্বিয়া : ৪৭)। হাদিসে সরষে হাদিসে বিভিন্নভাবে এসেছে সরষের কথা। কখনও উপমা-উদাহরণে, কখনও বৈষয়িক প্রসঙ্গের আলোচনায়। এক হাদিসে এসেছে, হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, 'জান্নাতিরা জান্নাতে এবং জাহান্নামিরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে, অতঃপর আল্লাহ তায়ালা বলবেন, বের করো যার অন্তরে সরষে পরিমাণ ঈমান রয়েছে, অতঃপর তারা সেখান থেকে কালো চেহারায় বের হবে এবং বৃষ্টির নহর বা সঞ্জীবনী নহরে তাদের নিক্ষেপ করা হবে। ফলে তারা নতুন জীবন লাভ করবে যেমন- নালার কিনারায় ঘাস জন্মায়। তুমি দেখনি তা হলুদ অাঁকাবাঁকা হয়ে গজায়?' (বোখারি ও মুসলিম)। বিভিন্ন ধর্মে সরষের ব্যবহার ইসলাম ধর্মে এটি শুধু আল্লাহ তায়ালার একটি উপকারী নেয়ামত হিসেবে পরিগণিত। ইহুদি ধর্মের দার্শনিকরা মনে করেন, সৃষ্টির শুরুলগ্নে এ পৃথিবী একটি সরষে দানার মতো ছোট ছিল। দিন দিন এটি প্রসারিত হয়েই চলেছে। ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকার ফল আজকের পৃথিবী। হিন্দুধর্মে পূজা-পার্বণে উপাসনার কাজে সরষের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, এতে অমঙ্গল দূর হয়। কোনো কোনো ব্রাহ্মণও উপাসনার কাজে এটি ব্যবহার করে থাকেন। বাইবেলেও আছে সরষের কথা। বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রে দুই ধরনের পূজার কথা বলা আছে, আমিষ পূজা ও নিরামিষ পূজা। আমিষ পূজাতে বিভিন্ন ফল-ফুল ও দ্বীপ-ধূপের সঙ্গে সরষেও রাখতে দেখা যায়। শেষের কথা ফুল ফোটার সুবর্ণ সময় শীতকাল। শীতের কত কত ফুল। কী তার মিষ্টি মিষ্টি নাম! গাঁদা, কসমস, ডালিয়া, গন্ধরাজ, সূর্যমুখী, চন্দ্রমলি্লকা, পপি, পর্তুলেখা, জিনিয়া, মোরগফুল, হলিহক, ক্যালেন্ডুলা, করিওপসিস, কর্নফ্লাওয়ার, লবেলিয়া, পেটুনিয়া আর ভার্বেনাসহ আরও কত মজার মজার নাম। এগুলোর মধ্যে গাঁদা আর সূর্যমুখী প্রায় সারা বছরই ফোটে। তবুও সরষের মহিমা কোথায় যেন একটু আলাদা। সরষে ঔষধিগুণসম্পন্ন। সরষে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের সহায়ক। সরষে কখনও কখনও খাবারও। সরষে ফুল আশ্চর্য সুন্দর রূপসী। শীতকালে তাই সব ফুল ছাড়িয়ে সরষে যেন প্রকৃতির বুকে বিছিয়ে দেয় হলদে চাদর। হলুদে হলুদে ভরিয়ে তোলে চারপাশ। সরষে যেন তাই হলদে শাড়ির পোশাকপরা শীতের অতিথি।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়