মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ:
মহান শিল্পীর সৃষ্টি কত সুন্দর! খুঁত নেই কোথাও কোনো। এর চেয়েও বেশি সুন্দর আমাদের চোখের এবং মনের দৃষ্টিতে যা ধরা পড়ে। এরশাদ হচ্ছে, 'দয়াময় স্রষ্টার সৃষ্টিতে তুমি কোনো খুঁত দেখতে পাবে না। তোমার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দেখো; কোনো ত্রুটি পাও কি? আবার দেখো; আবারও। তোমার দৃষ্টি তোমারই দিকে ফিরে আসবে ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে। (তবু...)।' (সূরা মুলক : ৩-৪)।
স্রষ্টার এত সুন্দর নিখুঁত সৃষ্টির মাঝে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। তাই পৃথিবীর সবকিছুই তিনি মানুষের জন্যই সাজিয়েছেন অপূর্ব সাজে। এ সুন্দর সুনীল আকাশ, সবুজ-শ্যামলে ভরা প্রকৃতি, অপরূপ সাগর-নদী আর পাখপাখালি-সবই তার মনোমুগ্ধকর সৃষ্টি। এরশাদ হচ্ছে, 'তারা কী নভোম-লের প্রতি দেখে না, কীভাবে তিনি তা বানিয়েছেন, সুশোভিত করেছেন। আর তাতে নেই কোনো স্তম্ভ!' (সূরা কাফ : ৬)।
শোভা-সুন্দরের রেশ ধরেই শীতের চাদর সরিয়ে প্রকৃতি যেন এখন আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। নাগরিক দ্বারে কোকিল না ডাকলেও মনের দরজায় অনবরত বাজছে কুহু কুহু...। কি জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়। ঝরাপাতার দিনকে বিদায় জানিয়ে আজ এলো বসন্ত। ষড়ঋতুর মাঝে প্রকৃতির রাজ্যের সিংহাসনের জন্য নির্ধারিত। প্রকৃতির সঙ্গে জেগে ওঠে দেহমন। মেঠোপথ থেকে রাজপথ সর্বত্রই লেগেছে ফাগুনের আগুন। প্রকৃতির এমন মাতমে মেতেই কবিগুরু লিখেছেন- 'আহা, আজি এ বসন্তে/ কতো ফুল ফোটে/ কতো বাঁশি বাজে/ কতো পাখি গায়...।' পাখির গানে গানে পলাশ, শিমুল ডালে ফুটে থাকে ফাগুন। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার শাখায় শাখায় যেন ফুটে ওঠে থোকা থোকা আগুন। ফাগুনের মোহনীয়তা নিয়েই সকালের সূর্যটা জাগে অন্য এক মাতমে। সকালের কাঁচা রোদ ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। মাতাল হাওয়ায় শাখে শাখে দোলে পাতা। নগরজীবনের সব ব্যস্ততা সত্ত্বেও মনের কোথাও যেন একটু শিহরণ জেগে ওঠে। কখনও বা উদাসী হয়ে ওঠে মন। কবির ভাষায়- 'বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে। ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে, পয়লা ফাল্গুন আনন্দ-দিনে।' নাগরিকরাও কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে- 'ফুল ফুটুক আর না-ই বা ফুটুক, আজ বসন্ত।' তাই তো পুরো শহরকেই যেন ফুলে ফুলে ভরে তোলে নগরবাসী। গাছে গাছে সি্নগ্ধ-সবুজ কচিপাতার ধীরগতিতে বাতাসের সঙ্গে বয়ে চলা জানান দেয় নতুন কিছুর। উদ্দামতা শেখায় কর্মীদের। স্রষ্টার কী অপরূপ সৃষ্টি! মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে নিজেরও অজান্তে। আল্লাহর এই বাণী : 'পৃথিবীর ওপর যা কিছু আছে, আমি সেগুলোকে তার শোভা করেছি, মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মাঝে কর্মে কে শ্রেষ্ঠ।' (সূরা কাহফ : ৭)।
বন-বাদাড়ে, কাননে-কাননে পারিজাতের রঙের কোলাহল আর বর্ণাঢ্য সমারোহে অশোক-কিংশুকে বিমোহিত হয়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়- 'এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/ খুনেরা ফাগুন।'
প্রকৃতিতে এখন বয়ে চলে দক্ষিণা হাওয়ার মাতাল সমীরণ। বাতাসে পাতাঝরার শব্দ। পলাশ, শিমুল গাছে লাগে বসন্তের ছোঁয়া। চন্দ্রমলি্লকা, গাঁদা, মালতি, মাধবী, বকুলসহ কত ফুল ফুটেছে। বসন্তের পাতাবিহীন ন্যাড়া ডালে আগুনের লেলিহান রক্ত আভায় শোভিত হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে শিমুল ফুলের সৌন্দর্য। গ্রামবাংলার চিরায়ত এসব চিত্র একদা দেখা যেত আমাদের এ নগরেও। অট্টালিকার ভিড়ে হারিয়ে গেছে শত প্রজাতির হাজারো ফুল-ফলের বৃক্ষরাজি। প্রকৃতির এ পরিবর্তন মূলত বসন্তের আগমনি বার্তা। প্রকৃতিতে এত বর্ণাঢ্যভাবে, রাজকীয়ভাবে আর কোনো ঋতুর অভিষেক ঘটে না। এ রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের কারণেই বসন্ত ঋতুরাজ। পৃথিবীতে বসন্তের আগমন মানেই উৎসব। অনেক দেশেই বসন্তের আগমনে নতুন বছরের সূচনা হয়।
তবে নতুন বছর হোক বা না হোক, বসন্তে আনন্দ-উৎসবের কোনো ঘাটতি হয় না। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। কৃষ্ণচূড়ার আগুনঝরা ঔজ্জ্বল্যে সেজে বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রান্তর মোহনীয় করে তোলে বসন্ত। প্রতি বছরই এ দিনে বাঙালি নানা উৎসবের আয়োজন করে। এত শোভার যিনি কারিগর তাঁকে মনে রাখছি তো আমরা?
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়