ইমতিয়াজ উল ইসলাম:
রাজধানীর লাগোয়া উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার আশুলিয়ার শিমুলিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের কাছৈর গ্রাম। এই গ্রামের ৯৫ ভাগ পরিবারের প্রধান কাজ ছাঁই থেকে পিতলের তৈজসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করা। গ্রামটির ৭/৮ হাজার মহিলা পুরুষ মেটাল ব্যবসা নামে এই পেশার সাথে জড়িত। যার যার বাড়ির আঙিনায় এভাবে পানিতে ছাঁই ধুয়ে পর্যায়ক্রমে পিতলের গুঁড়ি বের করা হয়। পরে গুঁড়ি রোদে শুকিয়ে ঢেঁকিতে পারানো হয়। এর পাশাপাশি মাটি ও ধানের তুস দিয়ে ঠুলি তৈরি করে এতে পিতলের গুঁড়ি ঢুকিয়ে আগুনে তাপ দিয়ে তরল পিতল করা হয়। এরপরই তরল পিতল থেকে তৈরি করা হয় বিভিন্ন ব্যবহার্য তৈজসপত্র।
রবিবার সকালে সরেজমিনে উপস্থিত হয়ে কাছ থেকে ছাঁই থেকে পিতলের তৈজসপত্র তৈরির বাস্তব তথ্যচিত্র দেখা যায়।
কাছৈর গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে তৈয়ব আলী (৫৫) ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কিভাবে তারা ছাঁই থেকে পিতলের তৈজসপত্র তৈরি করেন? এবং তা বাস্তবে তৈরি করেও দেখান। ছাঁই কেনা হয় ঢাকার দয়াগঞ্জের মুরগিটোলা, জুরাইন, পোস্তগোলা, মীর হাজীরবাগ ও যাত্রাবাড়ীর মৃধাবাড়ী হতে। ছাঁইগুলো তারা সংগ্রহ করেন মূলত স্টিল ও রড তৈরির কারখানা থেকে।
তিনি জানান, ৫০ কেজি ওজনের বস্তা এক হাজার ৫০০ টাকায় কিনেন তারা। ছাঁইয়ের বস্তা কাছৈর এলাকার তার নিজ বাড়িতে এনে স্টিলের বড় পাত্রে ঢেলে পার্শ্ববর্তী জলাশয়ের পানিতে ধৌত করেন। কারণ পানিতে ধোয়ার ফলে ছাঁইয়ের উচ্ছিষ্ট অংশ পানিতে ভেসে যায়। এরপর পাত্রের নিচে পিতলের গুঁড়ির তলানি পড়ে।
এভাবে এক বস্তা ছাঁই পানিতে ধোঁয়ার ফলে ১৫ কেজি পিতলের গুঁড়ি সংগ্রহ করা যায়। এভাবে একজন লেবার সকাল ৮টা হতে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৫-৭ বস্তা ছাঁই ধৌত করে শ্রম মজুরি পায় তিনশত টাকা। এরপর গুঁড়ি রোদে শুকিয়ে মহিলারা ঢেঁকিতে পারান। প্রতিটি ঢেঁকিতে ৩-৪ জন মহিলা শ্রম দেন। তাদের প্রতিজনকে শ্রম মজুরি দেয়া হয় একশ টাকা। ঢেঁকিতে পিতলের শুকানো গুঁড়ি পিষ্টের পর আবারও তা পানিতে ধোঁয়া হয়। আগের মতো পানি ছেকে রোদে শুকানো হয়। এরপর আবারও ঢেঁকিতে পারানোর পর পিতলের গুঁড়ি মাটি ও তুস দিয়ে তৈরি ঠুলিতে ঢুকানো হয়।
এক একটি ঠুলিতে ১০/১২ কেজি গুঁড়ি ধরে। গুঁড়িভর্তি ঠুলি তাদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি চুলায় ঢুকানো হয়। একটি চুলায় ৭টি ঠুলি ঢুকিয়ে কয়লার আগুনে তাপ দেয়া হয়। ঠুলি পুরে লাল টগবগে হলে চুলো থেকে উঠিয়ে উচ্ছিষ্ট অংশ উপর থেকে ফেলে দিয়ে এক ফুট দৈর্ঘে্যর আড়াই ইঞ্চি থেকে তিন ইঞ্চি চওড়া সাজের ভেতর তরল পিতল ঢালা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে তরল পিতল শক্ত হলে সেটি ঠান্ডা করে সাজ থেকে বের করা হয়। এটিকে বলা হয় পিতলের বাট। একটি ঠুলি থেকে ২টি বাট তৈরি হয়। যার প্রতিটির ওজন ৫ কেজি। এ বাটগুলো মহাজনদের কাছে বিক্রি করা হয় তিনশ টাকা কেজি দরে। আর এ বাট মহাজনেরা কামারের মাধ্যমে পিতলের বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি করেন বাজারে বিক্রি করেন। এতে তাদের খুব বেশি একটা লাভ থাকে না। কারণ তাদের তৈরি করা পিতলের বাটগুলো যদি তারা কোনো মাধ্যম ছাড়া বিক্রি করতেন তাহলে আরও বেশি লাভ হতো।
একই এলাকার কামার মজিন্দ্র বিশ্বাস (৫০) জানান, মহাজনেরা পিতলের বাট ও জ্বালানি হিসেবে কয়লা সাপ্লাই দেন। তাদের অর্ডার অনুযায়ী তৈরি করেন রাধাকান্তি, বিদ্যালয়ের ঘন্টাধ্বনি বেল, কাপ ও সানোক। এতে মজুরি হিসেবে প্রতি কেজিতে দেয়া হয় ৮৪ টাকা।
এই পেশার সাথে জড়িত বিলাস সাহা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ছাঁই কেনার জন্য এখন আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ হয় তাদের। কারণ হিসেবে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, পরিবহণ খরচ তিন গুণ বেশি, কাঁচামাল আনতে পথে পথে পুলিশের হয়রানি ও চাঁদা দেয়ার মতো নানাবিধ সমস্যা। এছাড়া কাছৈর গ্রাম চারদিকে নদীবেষ্টিত হওয়ায় অনত্র যোগাযোগ ভীষণ কষ্টসাধ্য হয়। তাই গ্রামের অনেকেই ধীরে ধীরে এই পেশার ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
তবে বর্তমানে প্রায় ২০০ বছর ধরে পূর্ব পুরুষদের দেওয়া এ পেশায় নিয়োজিতরা দিন দিন পেশা বদল করছেন। তাই মহাজনী অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এবং তাদের তৈরিকৃত পিতলের বাট ও তৈজসপত্র বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে ও দেশে আয় হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বলে এই পেশার সাথে জড়িতদের বিশ্বাস।
---ঢাকাটাইমস
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়