হাবিবা মুসতারী:
ভালোবাসা এমন একটি মৌলিক মানবীয় গুণ, যাকে ধারালো অস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অস্ত্রশক্তি ব্যবহার করে শত্রুকে বধ করা যায়; কিন্তু তার মন জয় করা যায় না। অথচ ভালোবাসার মাধ্যমে চরম শত্রুকেও পরম বন্ধুতে পরিণত করা যায়। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিশ্ব মানবতার মহান শিক্ষক সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, জগদ্বাসীর জন্য যিনি প্রেরিত হয়েছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামিন বা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে, সেই দয়া ও মায়ার নবী মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর ভালোবাসার ছোঁয়ায় ফুল ফুটেছিল মরুভূমিতে। অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী পরিণত হয়েছিল সোনালি পৃথিবীতে। জাহেলি যুগের সেই মানুষ যারা ছিল দয়ামায়া, ভালোবাসাহীন, পরস্পর শত্রুতা ও সন্ত্রাসী আচরণে অভ্যস্ত, তারা পরিচিত হলো একে অপরের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে। তারা নিজের কন্যাসন্তানকে নিজ হাতে কবর দিতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। কত নির্দয় নিষ্ঠুর আচরণ। এমন পাষাণ হৃদয়ের মানুষগুলো রাসূল (সা.) কে ভালোবেসে তাঁর প্রদর্শিত বিধান জীবনে ধারণ করে এমন হলো যে, নিজেরা অভুক্ত থেকে রাসূল (সা.) এর মেহমানকে পেটপুরে খাবার ব্যবস্থা করেছিল। মানুষের আচরণে এই যে পরিবর্তন, এই যে বৈপ্লবিক যুগের আগমন এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নাকি ভালোবাসা দিয়ে মানুষের হৃদয়-মন জয় করে?
ছোটবেলা থেকেই রাসূল (সা.) এর সততা-সত্যবাদিতা বিমোহিত করেছিল ওই অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষগুলোকে। তারা তাই কিশোর মুহাম্মদ (সা.) কে ভালোবাসত আস সাদিক (সত্যবাদী) বলে। যুবক বয়সে আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনবতী-রূপসী, জ্ঞানী ও মহৎ চরিত্রের অধিকারিণী খাদিজার ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে যোগ্যতা-দক্ষতা ও সততার পরিচয় প্রদান করেন। এতে মুগ্ধ হন স্বয়ং ধনবতী ও মহামতি খাদিজা (রা.)। ৪০ বছর বয়সী এ ভাগ্যবতী নারী দুই দুইবার স্বামী হারিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জীবনে আর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন না। কিন্তু আল আমিনের মতো মহৎ গুণাবলিসম্পন্ন যুবক ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁকেই জীবনসাথী হিসেবে পেতে অধীর আগ্রহী হয়ে পড়েন তিনি। আল্লাহর কৃপায় অবশেষে ধন্য হন তিনি। বিশ্বের সেরা বর-কনে আবদ্ধ হলেন বিবাহবন্ধনে। নব দাম্পত্য জীবন চলতে লাগল মধুর থেকে মধুর করে। পৃথিবীর ইতিহাসে অনুসরণীয় দাম্পত্য জীবন স্থাপন করেছিলেন তাঁরা, এটা সম্ভব হয়েছিল পরস্পরের প্রতি আস্থা-বিশ্বাস ও অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে।
মুহাম্মদ (সা.) ভালোবাসতেন তাঁর পরম প্রিয় সৃষ্টিকর্তা-পালনকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালাকে। আর আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসা লাভের উপায় হলো তাঁর সৃষ্টির সব মাখলুকাত (সৃষ্টি) কে ভালোবাসা। গাছপালা, তরুলতা, পাহাড়-পর্বত, আগুন-পানি, নদী-সাগর, চন্দ্র-সূর্য, রাত-দিন, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত সবই আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। গৃহপালিত জন্তু-জানোয়ার, গরু-ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া-গাধা, বন্য প্রাণী হাতি, হরিণ এমনকি হিংস্র প্রাণী বাঘ, ভালুক, সিংহ অজগর, শিয়াল-কুকুর এমনকি নিকৃষ্ট প্রাণী শূকরও আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি এবং এরা সবাই তাঁর সৃষ্ট পরিবারের একেকজন সদস্য। আর মানুষ! সে তো সব সৃষ্টির সেরাজীব। পৃথিবীর অন্যসব সৃষ্টি মানুষের সেবায় নিয়োজিত। রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহর ভালোবাসা প্রত্যাশা করলে মানুষকে ভালোবাস। এমনকি হাশরের দিন আল্লাহ বলবেন, আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, পিপাসার্ত ছিলাম, অসুস্থ ছিলাম; কিন্তু তোমরা আমায় খানাপিনা দাওনি ও সেবা-শুশ্রƒষা করনি। বান্দা বলবে, ওগো প্রভু! তুমি নিরাকার পৃথিবীতে তোমায় আমরা খুঁজে পাইনি, কীভাবে আমরা তোমার সেবা করব? আল্লাহ বলবেন, পৃথিবীতে আমার সেরাজীব মানুষ ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত ছিল। কেউ বা রোগাক্রান্ত ও অভাবী ছিল। যদি তোমরা সেদিন মানুষের ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের অভাব মেটাতে, খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করতে বা রোগীর সেবা করতে তাহলে আমার সন্তুষ্টি লাভ করতে সক্ষম হতে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা জগদ্বাসীর ওপর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দয়া করো, আসমানের মালিক তোমাদের ওপর করুণা-দয়া করবেন।’ মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার গুরুত্ব কত বেশি তা অনুধাবন করা যায় রাসূল (সা.) এর এ বাণী থেকে। তিনি এরশাদ করেন, তোমরা ততক্ষণ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না মোমিন হবে, আর ততক্ষণ মোমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না পরস্পরকে ভালোবাস। আমি কী তোমাদের এমন একটি বিষয়ে বলে দিব! যা তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি করবে? তা হচ্ছে তোমরা তোমাদের মধ্যে সালামের ব্যাপক প্রচলন করো। (মুসলিম)। স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালোবাসলে প্রকৃত পক্ষে স্রষ্টাকেই ভালোবাসা হয়।
এ পর্যায়ে আমরা ভালোবাসার নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
আসলে ভালোবাসা একটি আপেক্ষিক বিষয়। সমাজ বিজ্ঞানীরা তাই একেকজন একেকভাবে এটা উপস্থাপন করেছেন। কারও মতে, ভালোবাসার সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই, ভালো কামনা করা, মনের বিনিময়, ভাবের বিনিময়ে অপরকে বুঝতে পারা- এসবই ভালোবাসার অন্তর্ভুক্ত বলে কেউ কেউ বলে থাকেন। কেউ বলেন, অদৃশ্য সুতার টানই ভালোবাসা। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, মহাশূন্যের প্রতিটি নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহ যেমন একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান। আমাদের পৃথিবীর মানবসমাজে সন্তান, মাতা-পিতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব একে অপরের প্রতি যে টান তাকে বলে ভালোবাসা। পরস্পরের প্রতি এই যে আত্মার টান বিজ্ঞানীদের ভাষায় এটাই মধ্যাকর্ষণ শক্তি। অর্থাৎ মহাশূন্যে যা মধ্যাকর্ষণ শক্তি, পৃথিবীতে তারই নাম ভালোবাসা। মধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে বলেই চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পৃথিবী তথা মহাশূনের যাবতীয় সৃষ্টি যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কোনো কারণে মধ্যাকর্ষণ শক্তি রহিত বা ব্যর্থ হলে মহাশূন্যে মারাত্মক বিপর্যয় ও ধ্বংস অনিবার্য। অনুরূপভাবে মানবসমাজের একে অপরের প্রতি আত্মার যে টান (ভালোবাসা) রয়েছে এটি ছিন্ন হয়ে গেলে মানবসমাজ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অতএব ভালোবাসার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভালোবাসাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। মহান আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সৃষ্টির অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছে, ‘তাঁর নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটা হলো, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের সঙ্গী-সাথীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে সুখ-শান্তি লাভ করতে পার। আর তিনি তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব-ভালোবাসা ও দয়ামায়া সৃষ্টি করেছেন, নিশ্চয়ই যারা চিন্তাভাবনা করে তাদের জন্য এসবের মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা রূম-২১)। নারী-পুরুষের ভালোবাসা তাই চিরন্তন। একে অপরের পরিপূরক। নারীবিহীন পৃথিবী অপূর্ণাঙ্গ। কবির ভাষায়, ‘পৃথিবীর তসবীর রঙিন করেছে নারী, জীবনচিত্তের উষ্ণতা তারই সেতারের ধ্বনী।’ ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন যিনি এর প্রয়োগ পদ্ধতি ও বিধান দিয়েছেন স্বয়ং তিনি। তিনি হলেন মহান সৃষ্টা রাব্বুল আলামিন। তিনি তার সৃষ্টির সব প্রয়োজন পূরণ করেছেন। পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা, জৈবিক চাহিদা পূরণের প্রয়োজনে নারীর জন্য নর এবং নরের জন্য সৃষ্টি করেছেন নারী। নরনারীর জৈবিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থাকে সৃষ্টিকর্তা Discipline করেছেন। এ Discipline/Decoration/Design কতই না চমৎকার! একটি শুভক্ষণের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দুজন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে সৃষ্টি হয় একটি চেতনা, আবেগ, পবিত্র ভালোবাসা। একে অপরের নিরাপত্তাদানকারী। গড়ে ওঠে প্রেমের এক নতুন ভুবন। তারা গায় ভালোবাসার জয়গান। যে জন্য ছিল তারা অপেক্ষমাণ। জন্ম হয় মানবসমাজের আরও একটি ছোট Unit পরিবার। এ অকৃত্রিম প্রেম, মধুর ভালোবাসা, দয়া ও মায়া নিঃসন্দেহে সৃষ্টিকর্তার নিদর্শন।
রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্যই কাউকে ভালোবাসে অথবা ভালোবাসা থেকে বিরত থাকে বা ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্যই কাউকে দান করে অথবা দান করা থেকে বিরত থাকে সে ব্যক্তি তার ঈমান পূর্ণ করে নিল। (বোখারি)।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়