ফরিদ হাসান:
তিনি ১৯৪৯ সালে শিক্ষক হিসেবে প্রথম ক্লাস নেন। তারপর দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। ৯৩ বছর বয়সে এসেও সেই পেশার সঙ্গেই যুক্ত আছেন। তার হাত ধরেই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। যৌবনকালে তিনি যাদের পড়িয়েছেন, পড়াশোনায় দিয়েছেন হাতেখড়ি, তাদের ছেলেমেয়েদেরও পড়িয়েছেন তিনি। এখন পড়াচ্ছেন তৃতীয় প্রজন্ম। তার প্রাক্তন ছাত্রদের নাতি-নাতনিদের পড়াচ্ছেন শেষ বয়সে এসে। বর্তমানে স্কুলের যিনি প্রধান শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি তিনিও তার ছাত্র। এমনকি স্কুলের সত্তর ভাগ শিক্ষকই তার ছাত্র। তার ছাত্ররা জেলা প্রশাসক ও রাজনীতিবিদ হয়েছেন। রাজনীতিবিদ সুজিত রায় নন্দীও তার ছাত্র।
তার নাম বিজয় চন্দ্র দে। চাঁদপুরের ফরাক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক। এই বয়সেও বিজয় চন্দ্র দে আগের মতো ইংরেজি ক্লাস নেন। শিক্ষার্থীদের টেনস্, নাউন-প্রোনাউন বোঝান, ইংরেজিতে কথা বলেন অনর্গল। আর ফরাক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীরাও এই শিক্ষককে পেয়ে উল্লসিত। তার ক্লাসের জন্য তারা বসে থাকে অধীর আগ্রহে। বিজয় চন্দ্র দের মতো বয়সী শিক্ষক সম্ভবত চট্টগ্রাম বিভাগেও একজন নেই। আলোকিত এই শিক্ষক নিজেই যেন এক ইতিহাস।
শিক্ষকতায় কীভাবে এলেন জানতে চাইলে বিজয় চন্দ্র দে হাসেন। যেন খুঁজে নিচ্ছেন পুরনো দিনগুলোর কথা। স্মৃতি হাতড়ে বের করে আনছেন না বলা কথাগুলো। তিনি বলেন, আমি ফরাক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়েরই ছাত্র। এখান থেকেই আমি ম্যাট্রিক পাস করি। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পাস করি। শিক্ষক হওয়া আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল না। পড়াশোনা শেষ হলে বাবা বললেন শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে। বললেন, শিক্ষকতা পেশায় মানুষজনের যে সম্মান, শ্রদ্ধা তা অন্য কোনো পেশায় পাওয়া যাবে না। বাবার কথা মতোই শেষে শিক্ষকতাকে নিজের করে নিলাম। তবে এই বয়সে এসে মনে হয়েছে বাবা ঠিক বলেছিলেন। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। আমার জন্ম সার্থক হয়েছে।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বিজয় চন্দ্র দে বলেন, স্বাধীনতার পূর্বে এবং কয়েক বছর পরও দেখেছি পাসের হার ছিল কম কিন্তু গুণগত শিক্ষা ও শিক্ষার মান ছিল। বর্তমান সময়ে পাসের হার বেড়েছে কিন্তু শিক্ষার মান বাড়েনি। এখনকার শিক্ষাব্যবস্থায় আরেকটি পার্থক্য আমার চোখে পড়ে, তা হচ্ছে উন্নয়ন। আগের শিক্ষার্থীকে পায়ে হেঁটে দূর-দূরান্তে গিয়ে পড়তে হতো। এখন দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে গেছে। আগেরকার শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের বাবার মতো শ্রদ্ধা, গুরুর মতো ভক্তি এবং ভয় করত। স্যারদের সামনে দাঁড়িয়ে মারপিট তো দূরের কথা, কোনো কটু কথা বলতেও সাহস পেত না। এখন শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা কমেছে।
তিনি বলেন, দিন দিন পৃথিবী থেকে শ্রদ্ধা-আন্তরিকতা উঠে যাচ্ছে। শিক্ষকদের মূল্যায়ন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসছে। শ্রদ্ধা-সম্মান কমছে। অবশ্য তার জন্য শিক্ষকরাও কম দায়ী নয়। এমন কিছু তাদের করা উচিত নয় যাতে তার সম্মান ক্ষুণœ হয়। তবে তাদের মূল্যায়ন করে বেশিরভাগ লোকেই। এবার চাঁদপুর সেন্ট্রাল রোটারী ক্লাব থেকে সম্প্রতি আমাকে প্রবীণ শিক্ষক হিসেবে সম্মাননা দিয়েছে।
ফরাক্কাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আমিনুল হক মজুমদার। বিজয় চন্দ্র দে সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা অত্যন্ত গর্বিত এ জন্য যে বিজয় চন্দ্র স্যারের মতো একজন শিক্ষক এ স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তার মতো প্রবীণ শিক্ষক অন্যদের উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে এখনো ৯৩ বছর বয়সে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে থাকেন। তিনি আমারও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আমি তার ছাত্র। স্যার প্রতিদিন দুটি ক্লাস নেন। ইংরেজিতে তিনি অত্যন্ত দক্ষ। শিক্ষার্থীরাও তার ক্লাসের জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। সবার কাছে তিনি অভিভাবক, শিক্ষক ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।
স্কুলটির বর্তমান সভাপতি ড. হাসান খান। তিনি বলেন, বিজয় চন্দ্র স্যার আমারও শিক্ষক। আমি গর্বিত যে, তার মতো শিক্ষকের ছাত্র হতে পেরেছিলাম। তিন প্রজন্ম ধরে স্যার এই স্কুলে পড়াচ্ছেন। সারা দেশে তার হাজার হাজার গুণী শিক্ষার্থী রয়েছে। স্যার এখনো যে পড়াচ্ছেন তা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। তার মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক বোধহয় চট্টগ্রাম বিভাগে একজনও নেই।
এ বয়সে নিয়মিত ক্লাস নেন। কোনো অসুবিধা হয় কি? প্রশ্ন শুনে বিজয় চন্দ্র দে আবার হাসেন। বলেন, বিধাতার কৃপায় ৯৩ বছর বয়সে এসেও পাঠদান করতে অসুবিধা হয় না। আর শিক্ষার্থীরাই তো আমার প্রাণ। তারা আমার ক্লাস উপভোগ করে। আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। পাঠদান করাই আমার সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।
বিজয় চন্দ্র দে অবসরে গল্পের বই পড়েন। প্রাপ্তির হিসাব করতে গিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষকতা আমাকে সম্মান, শ্রদ্ধা, বেঁচে থাকার খোরাক সবই দিয়েছে। এ পেশায় এসে আমি পরিতৃপ্ত। কোনো অপূর্ণতা নেই।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়