Sunday, January 11

বিশ্ব ইজতেমার ২৪ ঘণ্টা


বয়ানে মুখর মিম্বরের আশপাশ একের পর এক বয়ান। বিভিন্ন ভাষা-বর্ণের নানা পেশা-শ্রেণীর শ্রোতা। বয়ানেও বেশ তারতম্য। কেউ উর্দু, কেউ বা মাতৃভাষায় বয়ান করছেন। অপরদিকে সামনে উন্মুখ হয়ে শুনছেন লাখো শ্রোতা। উপকৃত হন অনেক। বদলে নেন নিজের জীবনকে। বিভিন্ন ভাষা আর নানা মুখে বয়ান এবং বক্তা-দোভাষীদের বয়ানের শিরোনাম ভিন্ন হলেও সবার উদ্দেশ্য একই- দ্বীনের দাওয়াত ও মেহনতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা। দলে দলে ছাত্রসমাজ যতদূর চোখ যায় টুপি আর টুপি। একদিকে ছাত্রদের উদ্দেশে, অপরদিকে আলেমদের উদ্দেশে বয়ান হচ্ছে। সবাই উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে মিম্বরের দিকে। শুনছে উর্দু ও তার অনুবাদ বয়ান। কারোর মাঝে নেই কোনো ক্লান্তি-অনীহা। অপরদিকে ভেতরে তালিমের স্থলে পড়ে যায় প্রচন্ড ভিড়। সেখানে তারা ফাজায়েলে আমল, সাদাকাত, তাবলিগ আর মোন্তাখাব হাদিসসহ দাওয়াতে তাবলিগের বেশকিছু বইপত্র তালিমে মশগুল। বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে হালের তরুণদেরও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে দেখা যায়। আশপাশে কাউকে আবার একাকী জিকির, নিজ জায়নামাজে এবং কাউকে টয়লেটের পাশে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। নজর কাড়ে এক তরুণের অমায়িক কর্ম- সে বৃদ্ধদের দেখলে বাড়িয়ে দেয় সহায়তার হাত। রাতের ইজতেমা গভীর রাত। প্রায় পৌনে ২টা। ইজতেমা মাঠে নীরবতা নেমে এসেছে এরই মধ্যে। মুসলি্লরা সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে ব্যস্ত। অনেকে ঘুমিয়ে আছেন। কেউ বা নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছেন। পেশ করছেন মনের যত চাওয়া। আকাশে চাঁদ উঠেছে প্রতিদিনের মতো। এক খন্ড আলো ছাউনির সরু ছিদ্র ভেদ করে চোখে পড়ছে কারোর। কেউ কেউ ডান কাত হয়ে ঘুমুচ্ছেন। নাকডাকার শব্দ শোনা যায় পাশের কয়েকটা বিছানা থেকে। কারোর বা ঘুম হয় না। তাই বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়ছেন। প্রায় ৪০-এর কাছাকাছি বয়সী ক'জনকে দেখা গেল। এখানে একসঙ্গে ঘুমিয়ে আছে কত বড় বড় কর্মকর্তাসহ গার্মেন্ট ম্যানেজার-শ্রমিকও। দেখতে দেখতে রাত প্রায় শেষের দিকে। রাস্তায় মানুষের ভিড় ততটা লাগেনি এখনও। তাই লম্বা কদমে টয়লেটে হেঁটে যাচ্ছেন কয়েকজন তাবলিগকর্মী। কাউকে দেখা গেল টয়লেট পরিষ্কারে ব্যস্ত। ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির কথা কোনো ঝগড়া-বিবাদ আর ধাক্কাধাক্কি নেই ইজতেমায়। নেই কোনো মারামারি। অনর্থক কর্মকান্ডের চিন্তাও করা যায় না এখানে। সবাই শৃঙ্খলার সঙ্গে হাঁটছেন। মানুষের এত ভিড়েও ভ্রাতৃত্বের মধুময় দৃশ্য স্থাপন করছে প্রতিবারের বিশ্ব ইজতেমায়। জনসাধারণের ভিড় ঠেলে এগোই আবদুল্লাহপুর রাস্তা ধরে। নামাজের মিম্বরের পশ্চিমে তুরাগ নদ। সাদা কাগজে কালো হরফে লেখা- 'নদীর পানি ব্যবহার না করি।' আনুগত্যের কারণে সবাই এ কথা মেনে চলছে। ছোট্ট হাউসে রান্নাবান্না আর গোসলের প্রয়োজন সেরে নিতে দেখা যায় অনেককে। নানা ব্যবসায় ক্ষুদে ব্যবসায়ী তুরাগ নদ পারাপারের জন্য রয়েছে কয়েকটি স্টিলের সেতু। এর ওপর দিয়ে এগোই নদীর পশ্চিম দিকে। চোখে পড়ে হোগলা, ওজুর বদনা ও খাবার সরঞ্জামসহ রকমারি আসবাব বিক্রেতা। বিশ্ব ইজতেমা এলেই এসব ক্ষুদে ব্যবসায়ীর দেখা মেলে। সাভার থেকে আগত হোগলার ক্ষুদে ব্যবসায়ী ফারুক জানান, 'প্রতিবছরেই বিশ্ব ইজতেমায় আমি এসবের ব্যবসা করে থাকি। মোটামুটি ভালোই লাভ পাই। লোকসানের আশঙ্কা খুবই কম। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে ব্যবসা করতেও বেশ আনন্দ লাগে।' ইজতেমা উপলক্ষে প্রবেশদ্বারসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে অনেকে শরবত, মোবাইল লোড, মোবাইল চার্জ, ছোট পরিসরে বেকারির পসরাসহ আরও নানা ব্যবসা করে থাকেন। বেশ বেচা-বিক্রি হয় বলেও জানান কয়েকজন ক্ষুদে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। ভিক্ষুকদের আনাগোনা ইজতেমার আগমনীতে ভিক্ষুকদেরও আনাগোনা বেড়েছে। কেউ শুয়ে, কেউ বসে, কেউ সঙ্গে কাউকে নিয়ে, কেউ বা আবার জিকির, গান-গজল গেয়ে অর্থ কামাইয়ে ব্যস্ত। তবে এসবের ভিড়ে যেসব দৃশ্য বেশ নজর কাড়ে, তা হলো- ল্যাংড়া, বোবা, কানা, অন্ধ, বয়রা, খোঁড়াসহ বিকলাঙ্গ কিছু ভিক্ষুক। যাদের ইজতেমার এ ময়দান ছাড়া অন্য সময় নগরীর অন্য কোথাও তো দূরের কথা, টঙ্গীর আশপাশের এলাকাতেও দেখা যায় না। কারোর বা পা বড় কিংবা ছোট; নানা অভিনব দৃশ্য। 
-----মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়