চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মিঠানালা গ্রামের রামদয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের পুকুর পাড়ের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে বিরল প্রজাতির একটি গাছ। এটির বয়স আনুমানিক ২০০ বছর। গ্রামের মানুষের কাছে এটি ‘হান্জ ফল’ গাছ নামেই পরিচিত। গাছটির এমন নামকরণে স্থানীয়ভাবে বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে। এর প্রাকৃতিক আচরণ অন্য সব গাছ থেকে ভিন্ন। ভোর ৪টায় গাছের ডালে শোভা পায় ফুল, প্রথম সূর্যের হাতছানিতে এই ফুল কিছুটা ফলের আকৃতি ধারণ করে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই আবরণ আর রং বদলে ফলটি ধারণ করে সাদা রং। এলাকার মানুষের বদ্ধমূল ধারণা, ফলটি দিনে ধরে এবং দিনেই পাকে। তাই স্থানীয় ভাষায় এর নামকরণ হয়েছে ‘হান্জ ফল’। গাছটির ২০০ বছরের ইতিহাসে বেশকিছু গবেষণার কথা বলা হলেও এর কোনো বৈজ্ঞানিক নাম উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে ২০০০ সালে মিঠানালা রামদয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মরহুম আবুল ফারুক মিয়া এই প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী গাছটি নিয়ে গবেষণা করতে এসেছিলেন। সে সময় ওই বিজ্ঞানী ধারণা করে বলেছিলেন, মিঠানালা এলাকাটি বঙ্গোপসাগর উপকূল হওয়ায় কোনো জলোচ্ছ্বাসে আফ্রিকার গভীর কোনো জঙ্গল থেকে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের বীজ পানিতে ভেসে আসতে পারে।
বর্তমানে জানা গেছে, এই গাছে এক ধরণের নয়, দুই প্রকৃতিতে দু রকম ফল ধরে। তবে মানুষের এই ধারণা নিয়েও তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। প্রতি বছর বসন্তকালজুড়ে গাছে ফল ধরে। তবে ফলটির আকৃতি অনেকটা আঙুরের মতো। এলাকার লোকজনের মতে, ফলটি খেতে খুব সুস্বাদু। মজাদার হওয়ায় এই ফলটি এলাকার মানুষ এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত পর্যটক-আগন্তুকরা খুব মজা করে খায়। বিরল প্রজাতির এই গাছটি নিয়ে ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে নানা তথ্য প্রকাশিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা দল পর্যবেক্ষণে আসেন বলে জানান মিঠানালা রামদয়াল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক শফিউল আলম। তবে গবেষণার পরবর্তী কোনো বিষয় সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল নন বলেও জানান।
রামদয়াল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পুকুর পাড়ে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, গাছের প্রতি ডালে সবুজ প্রকৃতির অসংখ্য ফল ধরে আছে, যা স্কুলে আসা ছোট শিশু-কিশোররা গাছে উঠে খাচ্ছে। বিষয়টি অবাক হওয়ার মতো। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু বসন্তকালে এই গাছে ফল ধরে। কিন্তু গ্রীষ্মের শেষে বর্ষার আগমনের প্রথম ভাগে এই গাছটি স্বভাবসুলভ শাখা-প্রশাখা ছাড়িয়ে অসংখ্য ফল নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে! ফল সবুজ রং ধারণ করে আছে। আবরণ ছাড়ালে সাদা রঙের তরল আঠা বের হয়ে আসে। ভেতরে সাদা দানা, যা একসময় বীজ হয়ে চারা উৎপাদনে উপযোগী হয়ে ওঠে।
মিঠানালা গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাছটির ১০০ বছরের ইতিহাসে অনেক চারা উৎপাদন এবং রোপণ করা গেলেও চারা গাছটির বয়স ৪-৫ বছর হতে না হতেই এটি মারা যায়। কলম কিংবা ডাল ভেঙেও এলাকার মানুষ গাছ উৎপাদনে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এমন অনেকের সঙ্গে কথা হয় সেখানে গিয়ে। মধ্যম মিঠানালা গ্রামের ৭২ বছর বয়সী খোরশেদ আলম ২০১০ সালে বাড়ির আঙিনায় দুটি গাছ লাগান। ওইদিন তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় দুটি গাছ এখনো সবল-সতেজ আছে। তবে খোরশেদ আলম জানান, এর আগে যারা গাছের নিচ থেকে ছোট চারা এনে লাগিয়েছে, কেউই গাছটি বড় করতে পারেনি।
এলাকার ৬৬ বছর বয়সী সুদান চন্দ্র দাশ জানান, তার বাবা নিখিল চন্দ্র দাশ ৮০ বছর বয়সে মারা যান। বাবা তাকে বলেছিলেন তাদের ছোট বেলায় গাছটির আকৃতি বর্তমান অবস্থার মতোই দেখাত। তিনি আরো জানান, ছোট বেলায় তিনি গাছটি থেকে ফল খেয়েছেন। তার মতে, গাছটি তখনো বর্তমান আকৃতির ছিল। কথার একপর্যায়ে গাছটির উৎপত্তি বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ছোট বেলায় তারা বড়দের কাছ থেকে শুনেছিলেন, ১৮০০ খ্রিস্টাদ্ধে নন্দ কেরানী নামে একজন ব্যবসায়ী মিয়ানমারের রেংগুন শহরে ব্যবসা করতেন। তিনি নিজের বাড়ির সামনে এই গাছটি লাগিয়েছিলেন। এলাকার ফজলে এলাহী (৭০) জানান, তিনিও একই রকমভাবে বিষয়টি শুনেছেন। গাছটির আদিঅন্ত যা হোক না কেন, এই বিরল প্রজাতির গাছটি নিয়ে মানুষের দীর্ঘ দিনের ধারণা ভুল বলেই মনে হয়েছে এর প্রাকৃতিক নানা আচরণ লক্ষ করে।
এ সব বিষয়কে তুলে ধরে চট্টগ্রাম সরকারি মুহসীন কলেজের উদ্ভিদবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক সাইফুল করিমের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, গাছটি বিরল প্রজাতির এটি সঠিক। কিন্তু গাছের ফল সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা তা বদলাতে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রথমত বের করতে হবে গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম। তারপর বসন্তকালে যে ফল বা ফুল গাছটিতে ধরে তা নির্ণয় করতে হলে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বিশেষ করে বসন্তকালের যেটিকে মানুষ ফল মনে করে তাতে গর্ভাশয়ের কোনো অস্তিত্ব চোখে পড়ে কি না তা দেখার বিষয়। তবে কথা বলার একপর্যায়ে প্রতিবেদকের প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কে তিনি বলেন, অতি প্রাকৃতিক বিষয় ছাড়া বসন্তে এবং গ্রীষ্মে দু ঋতুতে দু রকম ফল হওয়ার কথা নয়। তবে এ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হলে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বছরের পর বছর বিরল প্রজাতির এই গাছটি নিয়ে স্থানীয় মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। বসন্তকাল এলেই উৎসুক মানুষ আর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা গাছটি এবং ‘হান্জ ফল’ (স্থানীয় নাম) দেখতে ভিড় জমায়। অনেকে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফুল থেকে একটি সুস্বাদু ফলে পরিণত হওয়ার দৃশ্য সরাসরি দেখার কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করেন। কিন্তু এ যাবৎকালে যারা এমন দৃশ্য দেখার চেষ্টা করেছে তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুল থেকে ফল হওয়ার বিষয়টি দৃশ্যত চোখে ধরা পড়ে না। তবে ১০ ঘণ্টার মধ্যেই মিষ্টি একটি ফল গাছের নিচে ঝরে পড়ার দৃশ্য উৎসুক মানুষ দেখেছে। এলাকার অনেক মানুষ নানা রোগমুক্তির অন্ধ বিশ্বাসে এই গাছটির ফল মানত করে খায়। অনেকে গাছের ডাল ভেঙে নিজের বাড়িতে একটি চারা তৈরির চেষ্টা করেন। মানুষ বসন্তকালে যেটিকে ফল হিসেবে ধরে নেয়, তাতে কোনো বীজের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে গ্রীষ্মকালের ফলটিতে বীজ হয় এবং বীজ থেকে চারা উৎপাদন হয় এবং ৪-৫ বছর বয়সে চারা গাছটি আর বেঁচে থাকে না। মানুষের এমন কৌতূহল যে গাছটি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো সে ব্যাপারে কোনো গবেষণা করেনি। গবেষণার মাধ্যমে বিরল প্রজাতির এই গাছ থেকে নতুন গাছ উৎপাদন এবং মিষ্টি প্রকৃতির এই ফল প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদন সম্ভব হলে দেশে একটি নতুন উদ্ভিদের প্রসার ঘটবে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে এই গাছ।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।
খবর বিভাগঃ
ফিচার
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়