Wednesday, January 21

শাবাশ সাকিব


মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল: সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনের নাম। জাতীয় দলের সাবেক এ অধিনায়ক মাঠ ও মাঠের বাইরে যেভাবে দাপট দেখিয়ে চলেছেন তাতে করে বিশ্বসেরা অনেক দলের খেলোয়াড়ের ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে অভিষেকের পর থেকে পারফরম্যান্সের কারণে কখনোই বাদ পড়েননি। ইনজুরি ও মাঠের বাইরে কিছু বিতর্কিত কর্মকা- তাকে দর্শকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও মাঠে নেমেই জবাব দিয়েছেন সবকিছুর। ক্লাব ক্রিকেট থেকে জাতীয় দল, জাতীয় দল থেকে আইপিএল, আইপিএল থেকে কাউন্টি ক্রিকেট এরপর বিগ ব্যাশ। সবখানেই সমান দাপুটে মাগুরার এই অলরাউন্ডার। ফুটবলার বাবার ক্রিকেটার সন্তান হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) অনুমতি না নিয়ে বিদেশে লিগ খেলতে যাওয়ার কারণে তাকে বিভিন্ন মেয়াদে ঘরোয়া, আন্তর্জাতিক ও বিনোদনী ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করে। নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে আসতে আপিল করার পর জাতীয় দলে তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ক্রিকেট বোর্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অ্যাওয়ে সিরিজে না খেললেও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাঠে নেমেই দেখালেন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। তখনি টেস্টের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে নিজের নাম সবার উপরে তুলে আনেন। সিরিজ শেষে দখল করেন টোয়েন্টি-২০ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের খেতাব। আর অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া টোয়েন্টি-২০ আসর বিগ ব্যাশে খেলার সময়ই হয়ে যায় একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। তিন ফরম্যাটে একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে এমন কৃতিত্বের দাবিদার হলেন তিনি। নিজস্ব অর্জনের পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়। দুঃসময়ের চাদরে ঢেকে থাকা গত বছর শেষে এসে মিলল সেই অতি আকাক্সিক্ষত জয়। প্রথমবারের মতো তিন ম্যাচ সিরিজের টেস্টে এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জয় নিশ্চিত করে বাংলাদেশের। পাঁচ বছর পর টেস্ট সিরিজ জয় যেন আনন্দের নতুন এক উপলক্ষ নিয়ে আসে। যেখানে আবারো নেতৃত্বে অন্য সবার চেয়ে আলাদা সাকিব। প্রথম টেস্টে ফিরেই নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। আর দ্বিতীয় টেস্টে সেঞ্চুরি করার পাশাপাশি নেন ১০ উইকেট। এ অর্জনে বিশ্ব ক্রিকেটের তিনজনের এলিট ক্লাবে জায়গা করে নেন। যেখানে উপরের দুটি নাম কিংবদন্তী স্যার ইয়ান বোথাম ও ইমরান খান। কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে জয় আকাশ কুসুম কল্পনার আরেক নাম হয়ে গিয়েছিল। পরিসংখ্যান বলছে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একদিনের সিরিজের আগে কোনো ওয়ানডে ম্যাচও জেতেনি বাংলাদেশ। এশিয়া কাপ ও টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটেও ছিল ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দি। ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর সাদা পোশাকে যাত্রা শুরু করার পর ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে আসে প্রথম জয়। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামের সেই জয়টি ছিল দেশের ৩৫তম ম্যাচে। ২০০৫ সালে অতি আকাক্সিক্ষত জয়ের পর ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দুটি জয়ই আসে সাকিবের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে গত সাত বছরেরও বেশি সময় যা কিছু অর্জন তাতে সাকিব আল হাসানের অবদানকে আলাদা করলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। ক্রিকেট এখন চলছে টেস্ট, ওয়ানডে ও টোয়েন্টি-২০ দিয়ে। তিন ক্রিকেট পছন্দ করার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সে কারণে সেরাদের বেছে নিতে গিয়ে পড়তে হয় ঝামেলায়। কেউ টেস্টে হিরো তো আবার ওয়ানডেতে জিরো। আবার যারা ওয়ানডের সেরা তাদের পক্ষে টেস্টের শ্রেষ্ঠত্ব কেবলি স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়। এলিট দর্শকদের কাছে টোয়েন্টি-২০’র গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও খেলাটির সিংহভাগ জুড়েই আছে মারদাঙ্গা ক্রিকেট। সে কারণেই বিশ্বসেরা হিসাব মেলাতে গিয়ে আলাদা করে বলতে হয় টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটের সেরা। তবে যখনই আমাদের সাকিব আল হাসানের প্রসঙ্গ আসে তখন অবলীলায় বলে দেওয়া যায় ‘বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার’। বিশ্ব ক্রিকেটে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই এখন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব। এর আগেও সেরা ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। তবে সেটা কখনো টেস্ট আবার কখনো ওয়ানডেতে। টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটেও সেরার মুকুট পরেছেন বেশ কয়েকবার। তবে একসঙ্গে তিন ফরম্যাটে সেরার মুকুট পরা এটাই প্রথম। এখন বলাই যায়, বাংলাদেশের সাকিব অবিসংবাদিত বিশ্বসেরা ক্রিকেটার! গত ১ ডিসেম্বরের পর আর কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচই খেলেননি তিনি। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ খেলার পর খেলেছেন প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে। আর এখন খেলছেন অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশে। আইসিসির ব্যক্তিগত র‌্যাংকিংয়ে উন্নতি কিংবা অবনতির জন্য সবসময় খেলতে হয় না। তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা খেললেই হলো। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে ব্যাট হাতে ১৫ রান করেন লংকান কাপ্তান অ্যাঞ্জেলা ম্যাথুস। বল হাতে কোনো উইকেট নিতে পারেননি তিনি। ওয়ানডে র‌্যাংকিংয়ের লড়াইটা এখন বেশ জমজমাটই বলা যায়। শীর্ষ চারজনকে আলাদা করেছে মোটে ১৩ পয়েন্ট! ৪০৩ পয়েন্ট নিয়ে সবার ওপরে সাকিব। সে কারণেই নিজ জায়গা থেকে উত্থান সাকিবের। ৩৯৭ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয়স্থানে মোহাম্মদ হাফিজ। ৩৯৫ পয়েন্ট তিনে ম্যাথুস আর ৩৯০ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ তিলকারতেœ দিলশান। ৩৪০ পয়েন্ট নিয়ে পাঁচ নম্বরে শহীদ আফ্রিদি। এক নম্বরের স্বাদ সাকিব পেয়েছিলেন ওয়ানডে ক্রিকেট দিয়ে। ২০০৯ সালের ২১ জানুয়ারির পর ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর শীর্ষে উঠে আসেন টেস্টে। এরপর নানা সময়ে তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটেই সেরা মুকুট গলায় পরেছিলেন। এবার তিন ফরম্যাটেই সেরা। অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে এর আগেও খেলেছেন সাকিব আল হাসান। স্পিনিং অলরাউন্ডার থাকার কারণে অনেকেই মনে করেছিলেন পেস সহায়ক উইকেটে তেমন একটা কার্যকরী হতে পারবেন না তিনি। কিন্তু প্রতিনিয়তই সবার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে চলেছেন জাতীয় দলের ওয়ানডের বর্তমান সহ-অধিনায়ক। গত ১৩ জানুয়ারি ব্রিসবেন হিটসকে একাই ধসিয়ে দেন তিনি। ৪ ওভার বল করে ১৩ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা পুরস্কারও বগলদাবা করেন তিনি। সঙ্গে একটি রান আউটের পাশাপাশি একটি ক্যাচও ধরেছেন। সাকিবের জন্যই মাত্র ৮০ রানে গুটিয়ে গেছে ব্রিসবেন। জবাব দিতে নেমে ৩৬ বল হাতে রেখে ৫ উইকেট হারিয়ে ম্যাচ জিতে নেয় সাকিবের দল মেলবোর্ন রেনিগেটস। প্রথমবারের মতো বিগ ব্যাশের ম্যাচসেরা পুরস্কার জিতলেন এ অলরাউন্ডার। সাকিবের প্রথম স্পেলেই ব্রিসবেন হিটসের ব্যাটিংয়ের মেরুদ- ভেঙে যায়। প্রথম তিন ওভার ৭ রান দিয়ে ৩ উইকেট দখল করেন সাকিব। শেষ ওভারে প্রতিপক্ষের সর্বোচ্চ স্কোরার কাটিংকে বোল্ড করে চতুর্থ উইকেট দখল করেন। এরপর চমৎকার একটি ক্যাচ ধরে ম্যাচের লাগাম টেনে ধরেন। সামনেই বিশ্বকাপ, সেখানে পেস সহায়ক উইকেটে খেলা হবে বলে প্রত্যাশা করা হলেও স্পিনাররাও যে হিসাবের বাইরে থাকবেন না এটা বলেই দেওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসতে যাচ্ছে। সেখানে এশিয়ার কন্ডিশনের সঙ্গে মেলানো দলগুলো কতটা ভালো করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলাদেশের সাফল্যের জন্য নিশ্চিতভাবেই চেয়ে থাকতে হবে সাকিব আল হাসানের দিকে। সামনেই বিশ্বকাপ। এবারের বিশ্বকাপে কেমন করবে বাংলাদেশ? সাকিব প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খুব ভালো করবে আশা করি। আমরা শেষ সিরিজটা ভালো খেলেছি। এটা আমাদের অনেক আত্মবিশ্বাসী করেছে। বিশ্বকাপের দুই সপ্তাহ আগে অস্ট্রেলিয়ায় যাব আমরা। সেখানে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সময় পাব। আশা করি গত সিরিজের আত্মবিশ্বাসটা কাজে লাগাতে পারব। বাংলাদেশের বিশ্বকাপে প্রথম লক্ষ্য দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা। সবাই মিলে সেই লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করব। ইনশাআল্ল¬াহ আমরা সফল হব বলেই প্রত্যাশা করছি।’ দর্শকদের সাফল্যের উদ্দেশ্যে সাকিব বলেন, ‘আমাদের দর্শক আছেন বলেই আমরা ভালো খেলতে পারি। এত দর্শক না থাকলে আমরাও উপভোগ করতাম না, তারাও করতেন না। আমরা যখন ক্রিকেট খেলি, তখনো চাই মাঠভর্তি দর্শক যারা উৎসাহ যোগায়। মাঠে গ্যালারি ভর্তি দর্শক থাকলে মজাটা অন্য রকম হয়। তারা কেউ না থাকলে প্রিমিয়ার লিগ বা ঘরোয়া ক্রিকেটে গ্যালারি ফাঁকা থাকে, তখন খেলার ধরনটা এক রকম হয়। আবার আন্তর্জাতিক ম্যাচে দর্শক যখন উপচে পড়া হয়, আমাদের সমর্থন করেন, সেটার অনুভূতিটা অন্য রকম। খেলাটা তো দর্শকদের জন্যই। আমরা খেলছি বাংলাদেশের জন্য, যারা মাঠে এসে খেলা দেখছেন, আমাদের জন্য দোয়া করেন।’ খেলোয়াড়দের নিজের নামে আত্মজীবনী প্রকাশ নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে সাকিবের জন্য নতুন এক উপলক্ষ হয়ে এসেছে বই প্রকাশ। সাকিব যখন অস্ট্রেলিয়ায় বিগ ব্যাশ খেলতে ব্যস্ত তখনই তার নামে প্রকাশিত হলো বই। সাকিবের মা এতদিন ছেলের খেলা দেখে আপ্লুত হয়েছেন। এবার ছেলেকে নিয়ে লেখা বই দেখে আপ্লুত হলেন শিরিন আক্তার। সাকিব আল হাসানকে নিয়ে লেখা বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের বই ‘সাকিব আল হাসান : আপন চোখে, ভিন্ন চোখে’র প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন তিনি। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বইয়ের মোড়ক খোলার পর সাকিবের মা বলেন, ‘এমন মুহূর্তের জন্য সবাই অপেক্ষা করে। এটি বিশেষ একটি মুহূর্ত। আমি খুবই খুশি হয়েছি যে, সাকিবকে নিয়ে একটি বই লেখা হয়েছে। আর সেই বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। আমি নিজে দেখেছি লেখককে এ বইটি লিখতে কত পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি সাকিবের এ বইয়ের সাফল্য কামনা করি।’ বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ‘সাকিব আল হাসান আমাদের ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ এক সদস্য। আমি চীন, কুয়েত, কোরিয়ার মতো দেশে গিয়েছি ক্রিকেট নিয়ে কাজ করতে, যারা ক্রিকেটেরও নাম শোনেনি মনে হয়, তারাও সাকিবকে চেনে।’ তিনি ক্রীড়াবিদদের নিয়ে আরও জীবনীগ্রন্থ লেখা হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আমিনুল ইসলাম বুলবুল নিজের আত্মজীবনী লেখার কাজ শুরু করারও ঘোষণা দেন। অনুষ্ঠানে বইয়ের লেখক দেবব্রত মুখোপাধ্যায় তার বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কেউ ভালো কোনো কাজ করে বিশ্বের এক নম্বর হবে, এটা আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না। সাকিব বাংলাদেশের সেই আইকনে পরিণত হয়েছেন।’ mhrashel00@gmail.com

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়