Wednesday, January 14

নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অনন্য উপমা


ড. মানজুরে ইলাহী: জানমালের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা : মুহাম্মদ (সা.) মানুষের জীবনের অধিকার ও জানমালের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছেন। নরহত্যা যেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল সেখানে নরহত্যাকে তিনি জঘন্য অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, 'সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার বানানো এবং মানুষকে হত্যা করা।' (বোখারি : ৬৮৭১)। মহানবী (সা.) বলেছেন, 'কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থানরত চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিককে হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত পাবে না। যদিও জান্নাতের সুঘ্রাণ ৪০ বছর দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়।' (বোখারি : ৩১৬৬)। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে (যাকে মানবাধিকারের আদি সনদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়) মহানবী (সা.) সব মানুষকে সম্ব্বোধন করে বলেছেন, 'নিশ্চয়ই তোমাদের পরস্পরের জীবন, সম্পদ এবং সম্ভ্রম তোমাদের (অবৈধ হস্তক্ষেপ থেকে) পবিত্র, যেরূপ তোমাদের এ দিন পবিত্র তোমাদের এ মাসে তোমাদের এ শহরে।' (বোখারি : ৬৭)। রাসূল (সা.) আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করেছেন এবং আত্মহত্যাকারী তার নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দেয়ার শাস্তি হিসেবে আখেরাতে আত্মহত্যার অনুরূপ পন্থায় শাস্তি ভোগ করবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। (বোখারি : ১২৫১)। জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগে, বিশেষত আরবদের নবজাতক বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের জন্মলাভের পরপরই দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা বা জীবন্ত প্রোথিত করার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। রাসূল (সা.) ইসলামী সমাজে শিশু হত্যার এ জঘন্য প্রবণতাকে দ-যোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে পবিত্র কোরআনের প্রত্যাদেশের মাধ্যমে শিশুদের জীবনের অধিকার ও নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করা হয়। স্বাধীনভাবে চলাচল, বসবাস, রাজনৈতিক আশ্রয় ও নাগরিকত্ব লাভের অধিকার প্রতিষ্ঠা : মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক প্রবর্তিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে রাষ্ট্রের যে কোনো স্থানে স্বাধীনভাবে চলাচল ও বসবাসের অধিকার প্রদান করে। একইভাবে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বাইরে যাওয়া ও অন্য রাষ্ট্রে বসবাসের অধিকারও প্রতিটি ব্যক্তিকে দেয়া হয়েছিল। তাঁর রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে একটি 'বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা' ধারণায় বিশ্বাসী ছিল। রাসূল (সা.) এর রাষ্ট্রদর্শন অনুযায়ী সমগ্র বিশ্ব আল্লাহর রাজত্বস্বরূপ- যা তিনি সব মানুষের চলাচল ও বসবাসের জন্য অবারিত করে দিয়েছেন। অমানবিক আচরণ থেকে মুক্তি লাভের অধিকার প্রতিষ্ঠা : শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো ব্যক্তিকে শারীরিক-মানসিক শাস্তিদান বা তাকে কষ্ট দেয়াকে রাসূল (সা.) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেছেন, 'প্রকৃত মুসলিম হচ্ছে সে ব্যক্তি, যার কথা বা হাত (কাজের নিপীড়ন) থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকেন।' (বোখারি : ৬৪৮৪)। এমনকি এক্ষেত্রে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত দৃঢ় ভাষায় তিনি বলেছেন, 'যদি কোনো মুসলিম অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার ওপর সাধ্যাতীত বোঝা (জিজিয়া বা প্রতিরক্ষা কর) চাপিয়ে দেয় অথবা তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষাবলম্ব্বন করব।' (বায়হাকি : ৫৭৫০)। রাসূল (সা.) কারও অপরাধের জন্য অন্যকে দন্ড দেয়ার যুগ যুগ ধরে প্রচলিত রেওয়াজও চিরতরে রহিত করে দেন। বিদায় হজের ঐতিহাসিক অভিভাষণে তিনি বলেন, 'জেনে রাখ, কারও অপরাধের জন্য তারা নিজেকেই দ- বহন করতে হবে। সুতরাং পিতার অপরাধের জন্য পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে দায়ী করা যাবে না।' (তিরমিজি : ২১৫৯)। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এ ঘোষণার মূলে ছিল কোরআনের সেই বাণী, 'প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী।' (সূরা তুর : ২১)। 'প্রতিটি ব্যক্তি যা অর্জন করে তা শুধু তারই ওপর বর্তায়, আর কেউ অন্যের বোঝা বহন করে না।' (সূরা আনআম : ১৬৪)। ন্যায়বিচার লাভের অধিকার প্রতিষ্ঠা : রাসূল (সা.) কর্তৃক প্রবর্তিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক-সামাজিক-পেশাগত মর্যাদা নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অধীনে স্বাভাবিক ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার লাভ করে। মূলত ন্যায়বিচার ধারণার ওপর ইসলামে এতটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, কোরআনে প্রায় ৬০টি আয়াতে এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন- একটি আয়াতে বলা হয়েছে, 'হে ঈমানদাররা! তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর জন্য সাক্ষীরূপে, যদিও তা তোমাদের নিজেদের কিংবা পিতামাতার অথবা নিকট আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।' (সূরা নিসা : ১৩৫)। রাসূল (সা.) প্রতিষ্ঠিত ইসলামী খেলাফতের শাসনামলে ইসলামে বিচার ব্যবস্থা যা শাসক গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপমুক্ত, স্বাধীন, অবাধ ও নিরপেক্ষ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে, তা ছিল মূলত রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মানবতাবোধ ও মানবাধিকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত। শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠা : কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ভাষায় মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন, 'আমি তোমাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।' (সূরা আম্বি্বয়া : ১০৭)। কোরআনের এ বাণী পরিপূর্ণভাবে সত্যে পরিণত করেছিলেন রাসূল (সা.)। সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র মানব জাতির ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অনন্যসাধারণ উদাহরণ রেখে গেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা আজও অদ্বিতীয় এবং সর্বজনস্বীকৃত অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে পরিগণিত। কেননা তিনি শুধু মুসলিমদের আদর্শ ছিলেন না, ছিলেন গোটা মানবজাতির আদর্শ। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এ মর্মে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন, 'বলুন (হে নবী), হে মানবজাতি, আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রাসূল।' (সূরা আরাফ : ১৫৮)। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়