দাওয়াত ও তাবলিগ মুসলিমদের কাছে দুটি অতিপরিচিত আরবি শব্দ- যার অর্থ যথাক্রমে আহ্বান করা, প্রচার করা বা পৌঁছে দেয়া। ইসলামী পরিভাষায় ইসলামের সুমহান আদর্শের প্রতি অন্যদের আহ্বান করা এবং এ ধর্মের বিধিবিধান তাদের কাছে পৌঁছে দেয়াকে দাওয়াত ও তাবলিগ বলে। তবে শব্দ দুটির মাঝে সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকলেও ব্যাপক অর্থে একটি অপরটির স্থলে ব্যবহৃত হয়। যিনি দাওয়াতি কাজ করেন, তাকে দায়ী এবং যিনি তাবলিগ করেন, তাকে মুবালি্লগ বা ধর্মপ্রচারক বলে। এ অর্থে বিশ্বের ইতিহাসে আল্লাহর বাণীর প্রতি প্রথম আহ্বানকারী এবং তাঁর বিধানের প্রথম প্রচারকারী হলেন নবী হজরত আদম (আ.)। অবশ্য আদম সন্তানদের মধ্যে কাবিলের আগে কেউ আল্লাহর অবাধ্য ছিল না। আর মুশরিকদের প্রতি প্রেরিত প্রথম ধর্মপ্রচারক আল্লাহ তায়ালার নির্বাচিত বান্দা ছিলেন নবী হজরত নুহ (আ.)। নুহ (আ.) এর পরে যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা তাঁর মহান বাণী প্রচার এবং সেদিকে মানুষকে আহ্বান করার জন্য অসংখ্য নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন এ ধরার বুকে- যাদের সবাই মানুষকে আহ্বান করেছেন সত্যের পথে; প্রচার করেছেন মহাসত্য বাণী। মহানবী (সা.) এর পূর্ববর্তী সব নবী ও রাসূল ছিলেন অঞ্চলভিত্তিক প্রেরিত। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলদের বিশেষভাবে তাদের গোত্রের কাছে পাঠানো হতো। আর আমাকে পাঠানো হয়েছে গোটা মানবজাতির জন্য। (বোখারি : ৪২৭)।
যেহেতু মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বনবী এবং তাঁর পরে এ পৃথিবীতে আর কোনো নবী বা রাসূল আগমন করবেন না, তাই স্বভাবতই তার ইন্তেকালের পরে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর ওপর বর্তানো দ্বীন প্রচারের এ মহান দায়িত্ব পড়ে তার প্রিয় উম্মতের কাঁধে। শুধু যুক্তি নয়, বরং স্বয়ং মুহাম্মদ (সা.)ও এ নির্দেশ দিয়ে গেছেন। বিদায় হজের ভাষণ শেষে তিনি বলেছিলেন, 'তোমাদের মধ্যে যারা উপস্থিত, তারা যেন এ কথাগুলো অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দেয়।' (বোখারি : ৬৭)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, অপর হাদিসে তিনি বলেন, আমার থেকে একটি বাণী হলেও তোমরা পৌঁছে দাও। (বোখারি : ৩২৭৪)। আর মহান প্রভু আল্লাহ তায়ালাও এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে দাওয়াত ও তাবলিগের প্রসঙ্গ টেনেছেন। আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মদিকে লক্ষ্য করে বলেন, 'তোমরা হলে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের উপকারের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ করো এবং অসৎকাজ থেকে বাধা দাও, আর তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমানও রাখো।' (সূরা আলে ইমরান : ১১০)।
আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশে উম্মতে মুহাম্মদি যুগে যুগে সর্বাত্মকভাবে দ্বীন প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছেন। মহানবী (সা.) এর পরে সাহাবায়ে কেরাম ওয়াজ, তালিম ও জিহাদের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত এবং তাবলিগের দায়িত্ব আনজাম দিয়েছেন। তাদের পরে তাবেয়িন এবং তাবে তাবেয়িন ওলামায়ে কেরাম দ্বীনি দাওয়াতের পূর্ববর্তী মাধ্যমের সঙ্গে পুস্তক রচনাকে যোগ করে দ্বীন প্রচারের ধারা অব্যাহত রাখেন। এর পরে যুগে যুগে অসংখ্য অলি-আউলিয়া, পীর-দরবেশ দাওয়াত ও তাবলিগের এ মহান দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মুসলিম দেশ থেকে নানা সময় আউলিয়ায়ে কেরাম দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দায়ী ও মুবালি্লগ বেশে অমুসলিম দেশে প্রবেশ করেছেন- যার প্রভাবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ ভূখণ্ড ও আজ মুসলিমপ্রধান দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। যে আউলিয়ায়ে কেরাম এ দেশে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে সিলেটের শাহজালাল (রহ.), চট্টগ্রামের শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রহ.), বাগেরহাটের খানজাহান আলী (রহ.), মহাস্থানগড়ের শাহ সুলতান মাহি সওয়ার (রহ.) এবং রাজশাহীর শাহমখদুম রূপোশ (রহ.) উল্লেখযোগ্য।
নিজ গ-ির মধ্যে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ করা ফরজে আইন, আর ব্যাপকভাবে এ কাজ করা ফরজে কেফায়া। ফরজে কেফায়ার দায়িত্ব কিছু লোক পালন করলে অন্যরা গোনাহ থেকে মুক্ত থাকবেন; আর কেউ পালন না করলে সবাই গোনাহগার হবে। দাওয়াত ও তাবলিগের অনেক ফজিলতের কথা কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'ওই ব্যক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করে এবং নিজে নেক আমল করে আর বলে, নিশ্চয় আমি মুসলিমদের একজন।' (সূরা ফুসসিলাত : ৩৩)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, 'যে ব্যক্তি কাউকে ভালো পথে আহ্বান করবে, সে ওই দাওয়াত গ্রহণকারীদের সমান সওয়াব লাভ করবে। এতে তাদের সওয়াবের কোনো ঘাটতি হবে না।' (মুসলিম : ৬৯৮০)। তবে দাওয়াত ও তাবলিগের লক্ষ্য হতে হবে খালেসভাবে মানুষকে সিরাতে মোস্তাকিম বা সঠিক পথের সন্ধান দেয়া। অবশ্য এজন্য দায়ী তথা দ্বীন প্রচারের যোগ্যতামূলক কিছু শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে সর্বপ্রধান শর্ত হলো দায়ীকে আলেম হতে হবে, তথা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। জাহেল তো নিজেই সঠিক পথ চেনে না; তাহলে সে কীভাবে অন্যদের সঠিক পথের সন্ধান দেবে? তাছাড়া দাওয়াতি কাজ একটি মহামূল্যবান নেক আমল। আর ইলম বা জ্ঞান ছাড়া নেক আমল বিশুদ্ধভাবে আদায় করা যায় না। এজন্যই মহানবী (সা.) সব মুসলিমের জন্য জ্ঞানার্জন ফরজ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। জ্ঞানার্জন ছাড়া দাওয়াতি কাজ করা যায় না। এ সম্পর্কে কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে, '(হে নবী) আপনি বলুন, এটা আমার রাস্তা। আমি এবং আমার অনুসারীরা বুঝে-শুনে আল্লাহর দিকে আহ্বান করি।' (সূরা ইউসুফ : ১০৮)। জ্ঞানার্জন ছাড়াও ধর্মপ্রচারকের আরও যেসব গুণ থাকা বাঞ্ছনীয়, তা হলো দৃঢ় ঈমান, ইলমমোতাবেক আমল করা, সততা, ধৈর্য, বিনয়, নম্রতা, প্রজ্ঞা ইত্যাদি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'ডাকো তোমার প্রভুর পথে, প্রজ্ঞা এবং উত্তম নসিহতের মাধ্যমে।' (সূরা নাহল : ১২৫)।
দাওয়াত ও তাবলিগ মূলত ইকামতে দ্বীন। সমাজে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য করণীয় কাজের অন্যতম। এ দাওয়াত নানাভাবে সম্পাদন করা যায়; যেমন ওয়াজ, বক্তৃতা, লেকচার, তালিম, তাজকিয়া, বিতর্ক, সেমিনার, প্রবন্ধ রচনা, কবিতা রচনা, পুস্তক রচনা, পত্রিকা প্রকাশ, রেডিও, অডিও, ভিডিও, ফেসবুক, ইন্টারনেট ইত্যাদি। অবশ্য দাওয়াতি কাজের কিছু পর্যায় রয়েছে। অমুসলিম হলে আগে ঈমানের দাওয়াত দিতে হবে (এটা অমুসলিমদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)। অতঃপর আমলের দাওয়াত দিতে হবে। যেমন সাহাবি হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) কে ইয়েমেনে পাঠানোর ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) তাকে কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। দায়ীর জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, 'হে মুয়াজ, তুমি আহলে কিতাবদের কাছে যাচ্ছ; সুতরাং প্রথমে তাদের তাওহিদ ও রেসালাতের সাক্ষ্যের প্রতি আহ্বান করবে। যদি তার এ দাওয়াত মেনে নেয়, তবে তাদের জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর দিনে ও রাতে মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন।' (মুসলিম : ১৩০)।
দাওয়াত ও তাবলিগের এ দায়িত্ব হলো নবী করিম (সা.) এর উত্তরসূরি ওলামায়ে কেরামের ওপর। তাদের কর্তব্য হলো অমুসলিমদের কাছে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করা, মুসলিম জনগণকে দ্বীনের তালিম দেয়া এবং দ্বীনভোলা মুসলিমদের সতর্ক করা। দেশের হাক্কানি পীর-মাশায়েখ এবং ওলামায়ে কেরাম নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
লেখক : প্রধান মোহাদ্দেস, দারুননাজাত সিদ্দিকীয়া
কামিল মাদরাসা
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়