Sunday, January 11

দাওয়াত, তাবলিগ ও বিশ্ব ইজতেমা


আমিন ইকবাল 'তাবলিগ' আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো প্রচার করা, প্রসার করা,পৌঁছানো প্রভৃতি। পরিভাষায় একজনের অর্জিত জ্ঞান বা শিক্ষা নিজ ইচ্ছা ও চেষ্টার মাধ্যমে অন্যের কাছে পৌঁছানো বা শিক্ষা দেয়াকে তাবলিগ বলা হয়। তাবলিগ নবীদের পুণ্যময় কাফেলা। শেষ নবীর তিরোধানের পর এ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তাঁর সব অনুসারীর কাঁধে। কোরআনে আল্লাহ নবীদের কাজ সম্পর্কে বলেছেন, 'আমি তোমাদের প্রতিপালকের পয়গাম পৌঁছাই এবং আমি তোমাদের বিশ্বস্ত হিতাকাঙ্ক্ষী।' (সূরা আরাফ : ৬৮)। মহানবী (সা.) বলেন, 'তোমার কাছে যদি কোনো বাণী থাকে তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।' উদ্ধৃত আয়াত ও হাদিসে আরবি তাবলিগ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। 'ইজতেমা' শব্দের অর্থ সভা-সমাবেশ বা সম্মেলন। পারিভাষিকভাবে এটি বাংলাদেশে ধর্মীয় সমাবেশ বিশেষত তাবলিগের সম্মেলনে অধিক ব্যবহৃত ও পরিচিত। ইসলামে সুন্দর মানবিক আদর্শ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে তুলে ধরার মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এ মহাসম্মেলনে সমবেত হন। একইসঙ্গে মিলিত হন বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশ থেকে আগত হাজার হাজার তাবলিগ অনুসারী ঈমানদার মুসলি্ল। তারা কোনো বৈষয়িক লাভের আশা না করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বীনের মেহনত করে ইজতেমা ময়দানকে মুসলিম মহামিলনের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন। বলা চলে- তাওহিদের শক্তিতে বলীয়ান হতে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্ব ইজতেমা তাবলিগ জামাতের সবচেয়ে বড় সম্মেলন। আবার অন্যদিক থেকে হজের পর ইসলামী দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জমায়েত। বিশ্ব ইজতেমায় পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ থেকে মুসলমানরা অংশগ্রহণ করেন। নানা মাজহাব এবং মত ও পথের মুসলমানরা এখানে হাজিরা দেন। একই শামিয়ানার নিচে অবস্থান করেন। প্রতি বছর শীতকালে (ডিসেম্বর/জানুয়ারি) ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। তাবলিগ জামাতের ইতিহাসে এ ধরনের সমাবেশের নজির প্রথম থেকেই রয়েছে। ১৯১০ সালে ভারতবর্ষের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা ইলিয়াছ কান্দলবী (রহ.) তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন রাজস্থানের মেওয়াত নামক এলাকা থেকে। একইসঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মেলন বা ইজতেমারও আয়োজন করেন। বাংলাদেশে ১৯৫০-এর দশকে তাবলিগ জামাতের প্রচলন করেন মাওলানা আবদুল আজিজ। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ থেকে বিশ্ব ইজতেমা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয়। ১৯৪৬ সালে প্রথম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় কাকরাইল মসজিদে। ১৯৪৮ সালে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে এবং ১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর রেলস্টেশনের পাশে পাগাড়ে অনুষ্ঠিত ইজতেমায় সর্বপ্রথম বাংলাদেশ ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশের মুসলি্ল অংশগ্রহণ করেন। স্থান সঙ্কুলানে সমস্যা হলে পরের বছর অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে টঙ্গীর কহরদরিয়া বা তুরাগ নদীর পূর্ব তীরে। এ খোলা ভূমি ছিল রাজউকের হুকুম দখলকৃত জমি। তুরাগের পাড়ে ১৬০ একর জায়গায় ১৯৬৭ সাল থেকে দীর্ঘ ৪৯ বছর ধরে একই স্থানে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তারপরও স্থান সঙ্কুলানে বড় সমস্যা থেকে গেছে। তাই ২০১১ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে একই বছর দুইবার বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সাধারণত তাবলিগ জামাতের অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্ন তিন দিন আল্লাহর পথে কাটানোর নিয়ত করে থাকেন। সে হিসেবে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনজুড়ে। এ তিন দিনের মধ্যে শুক্রবারকে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। শুক্রবার ফজর নামাজের আম বয়ান বা উন্মুক্ত বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হয় ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা এবং রোববার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়। অনেকে শুধু জুমার নামাজ কিংবা আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেন আখেরি মোনাজাতে। ইজতেমা মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য লালন করে আসছে। আল্লাহ উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন। ইজতেমায় সে বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ইসলামের আদর্শ সামনে রেখে এখানে কোনো মুসলমানকে ছোট করে দেখা হয় না। আল্লাহর কাছে প্রত্যেক মুসলমানের মূল্য আছে- এখানে এটা ভালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। মুসলমানদের কোনো ভাগে বিভক্ত করা হয় না। এক মুসলমান যেন আরেক মুসলমানকে সম্মান করে সেজন্য জোর তাগিদ দেয়া হয়। কোনো মাজহাবের মুসলমানকে খাটো করা হয় না। বরং সবাইকে ঈমান ও আমলের মেহনতের প্রতি আহ্বান করা হয়। তারা একই প্লেটে খাবার খান, একইসঙ্গে ঘুমান। কারও মধ্যে কোনো হিংসা, ঘৃণা থাকে না। সাদা-কালোর পার্থক্য থাকে না। সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ থাকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী সব মানুষের চাওয়া-পাওয়া এক হয়ে যায়।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়