আজহারুল হক, গফরগাঁও: বিশাল জাতের গাছগুলোর মধ্যে বৃষ্টি গাছ (রেইন ট্রি কড়ই) একটু আলাদা। বটবৃক্ষ দেখলে সহজে চেনা যায়। বৃষ্টি গাছ নজরে আসার পর প্রথমে বট বলে মনে হতে পারে। চৈত্রের ভরদুপুরে বিশাল এই গাছের সু-শীতল ছায়ায় বসে অল্প সময় বিশ্রাম নেওয়ার পর উপরে তাকালে বুঝা যায় এটি বটবৃক্ষ নয়, এটি বৃষ্টি গাছ (রেইন ট্রি কড়ই), ইংরেজি নাম Rain Tree।
গাছের মধ্যে বট অনেক বড়, চারপাশে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটায়। বৃষ্টি বা রেইন ট্রি গাছ এর ব্যতিক্রম। অন্য কড়ই গাছ থেকে একদমই আলাদা এই রেইন ট্রি। বট-পাকুরের মতো চারদিকে অনেক উঁচুতে শাখা-প্রশাখার বিস্তার রোদকে ঢেকে ছায়া দেয়। আড়াইশ বছরের পুরোনো এমনই কয়েকটি সু-বিশাল ও সু-উচ্চ বৃষ্টি গাছ এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে।
ব্রিটিশ শাসনামলে বড় বড় শহরের প্রধান সড়কের ধারে, জেলার কালেক্টর অফিসের সামনে, সরকারি রেস্ট হাউজের আঙ্গিনায় বড় বড় দেশীয় কড়ই গাছ ছিল। এখন আর এসব কড়ই গাছের অস্তিত্ব তেমন একটা চোখে পড়ে না। গ্রাম-গঞ্জের দিকেও একই অবস্থা।
ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের প্রবীন ব্যক্তিরা জানান, একসময় এই অঞ্চলে শুধু রেইন ট্রি কড়ই নয় (বৃষ্টি গাছ), বড় বড় বট বৃক্ষও দেখা যেত। দুপুরে গ্রাম থেকে গরুর গাড়ীতে করে আসা নববধুসহ বরযাত্রীরা এই বিশাল-বিশাল বৃষ্টি গাছগুলোর নিচে বসে চৈত্রের দুপুরে শীতল হতো।
১৭৫৭ সালের পর ১৭৬৫ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বার্ষিক ২৬ লাখ টাকার বিনিময়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে খাজনা আদায় শুরু করে। ১৭৯৩ সালের ৬ই মার্চ লর্ড কর্ণওয়ালিশ বাংলাকে তিনটি তালুকে ভাগ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেন। এর এক ভাগ নেন তৎকালীন জমিদারের তহশিলদার রাজনারায়ণ চক্রবর্তী (ত্রিশালের জমিদার)।
রাজ নারায়ণ চক্রবর্তী একটি তালুকের বন্দোবস্ত নেওয়ার পর গফরগাঁও উপজেলার দত্তেরবাজার ইউনিয়নের কণ্যামণ্ডলে একটি কাচারি স্থাপন করে খাজনা আদায় শুরু করেন। এটি পরবর্তীতে যোগেশ বাবুর কাচারি নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি ১৭৯৫ সালে (কথিত আছে) ভারত থেকে ৪টি বৃষ্টি গাছ (রেইন ট্রি কড়ই), দুটি বট, ৫টি আম ও শিমুল গাছ এনে কাচারিটির আঙ্গিনায় রোপন করেন। বর্তমানে দুটি বৃষ্টি একটি আম একটি বট গাছ জীবিত আছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কণ্যামণ্ডল নামক ওই কাচারিতে আশ্রয় নেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। কাচারির আঙ্গিনায় দুশ’ বছরের পুরোনো একটি বৃষ্টি গাছ দাঁড়িয়ে ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা বিশাল ওই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পাক সেনাদের মোকাবেলা করত।
বর্তমানে খান বাহাদুর ইসমাইল রোড থেকে গফরগাঁওয়ের বরমী সড়ক হয়ে পাগলা থানার দত্তের বাজার ইউনিয়নের কণ্যামণ্ডল গ্রামে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী এই বৃষ্টি ও বট গাছ। গফরগাঁও ভালুকা সড়কে কৃষ্ট বাজারে দুটি বৃষ্টি গাছ, খান বাহাদুর ইসমাইল রোডের পাঁচপাই কাচারিতে একটি বৃষ্টি গাছ কোনোমতে টিকে আছে।
২০০৩ সালে বিএনপি জামায়াত সরকারের সময় রাস্তা বড় করার কথা বলে আড়াইশ বছরের পুরোনো এইসব গাছ কাটতে গেলে সুধীজনসহ এলাকাবাসী প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিবাদের মুখে বাজারমুখী সড়কের কোনো গাছ কাটা হয়নি। এই বৃষ্টি গাছগুলো চৈত্রের দাবদাহের মধ্যে এই সড়কে চলাচলকারী পথচারীদের শীতল করে। ভাসমানদের অনেকে গাছের নীচে তপ্ত দুপুরে ঘুমায়। এছাড়াও সম্প্রতি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা গাছের নিচে পথচারীদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সিমেন্টের বেঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন।
গাছগুলোর বেড় ৪ থেকে সাড়ে ৫ মিটার। বাকল কিছুটা কালচে মসৃণ। বৃষ্টি গাছের কাঠ খুবই শক্ত, ওজনে ভারী। প্রতি ঘনমিটার কাঠের ওজন প্রায় সাড়ে ৭ কেজি। দরজা-জানালা, আসবাবপত্র, নৌকা, ঘরের খুঁটিও হয় এই বৃষ্টি গাছের কাঠ দিয়ে। এই বৃষ্টি গাছ ঘিরে প্রচলিত আছে নানা কাহিনী। গল্পে বৃষ্টি গাছে যাই থাক না কেন বাস্তবতা হল- সময়ের ধারায় তা প্রকৃতির চিত্র তুলে ধরে, ধারণ করে রাখে বহুবছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
সূতরাং মানুষের কুড়ালের আঘাত থেকে রক্ষা করে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এই বৃষ্টি গাছগুলোকে টিকিয়ে রাখা অতীব প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন, কণ্যামণ্ডল নিবাসী আক্কাস আলী (৯০), ও বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুজিবনগর সরকারের আজীবন সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক শেখ রিয়াজ উদ্দিনসহ অসংখ্য গুনীজন।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়