Wednesday, December 17

বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মৌলবি মোহাম্মদ আবুল কাশেম কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার কাজীয়াতল গ্রামে ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় কাজীয়াতল গ্রামের মাদরাসা-ই-ফ্রি ফোরকানিয়ার মাধ্যমে। এরপর তিনি কিছুদিন এ মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। তিনি সাধারণ শিক্ষাও গ্রহণ করেন। পরবর্তী জীবনে জড়িয়ে পড়েন ব্যবসায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও রণাঙ্গনের সরাসরি যোদ্ধা। যুদ্ধে যাওয়ার প্রেক্ষাপট ও রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে তিনি আলোকিত বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেন। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর পরিকল্পনায় আমানুল্লাহ নোমানের নেয়া সাক্ষাৎকারের আলোকে বিজয়ের এ মাসে মুক্তিযুদ্ধে আলেমসমাজ নিয়ে আমাদের বিশেষ আয়োজনে আজ থাকছে ১২তম পর্ব। আলোকিত বাংলাদেশ : মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেরণা কীভাবে পেলেন? মোহাম্মদ আবুল কাশেম : পাকবাহিনী অমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করেছে, যা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। বিশেষ করে আমাদের মা-বোনদের ওপর যেসব অত্যাচার করেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এসব দেখে আমি ঈমানি দায়িত্ব হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর এক ভাষণে আমি শুনেছিলাম তিনি সেখানে বলেছেন, কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করা হবে না। মূলত বঙ্গবন্ধুর এ কথা আমাকে মুক্তিযুদ্ধে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। সরাসরি যুদ্ধে কীভাবে জড়ালেন? ** প্রথমে আমরা কয়েক বন্ধু মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই। আমরা একসঙ্গে ২৬ জন ট্রেনিং নেয়ার জন্য ভারতের পালাটোনায় এবং মেলাঘরে যুদ্ধের ট্রেনিং নিই। ট্রেনিং শেষে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। যেখানে পাকবাহিনীর বড় একটি ঘাঁটি ছিল। বাংলাদেশে ঢুকতেই আমরা পাকবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ি। এর পরে আমরা আমাদের থানায় চলে আসি। আমরা আমাদের এলাকায় পীর কাশিমপুরনামক স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করি। যুদ্ধের কিছু স্মৃতি বলুন? ** রণাঙ্গনে আমরা বেশ কয়েকবার পাকবাহিনীর মুখোমুখি হই। প্রথম মুখোমুখি হই আমাদের থানার পান্তিবাজারনামক স্থানে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধে মুখোমুখি হই কুমিল্লা জেলার হোমনা থানায়। সেখানে কয়েক দিন যুদ্ধ চলে। অবশেষে পাকবাহিনী পরাজিত হয়, কিন্তু আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। অনেক যোদ্ধা সেখানে শহীদ হন। আমাদের যুদ্ধ দেখে এলাকার সবাই আশান্বিত হয়। যুদ্ধের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনাটি বলুন? ** মুরাদনগর থানা আক্রমণ যুদ্ধের স্মরণীয় একটি ঘটনা। বিনা রক্তপাতে আমরা মুরাদনগর থানা দখল করি। শুধু কৌশলের কারণে আমরা জিতে যাই। আমরা ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। সবাই একটি করে বাংকার করি। এসব দেখে পাকবাহিনী ঘাবড়ে যায়। আমাদের হাতে ছিল দুটি এলএমজি, ১০০ থ্রি নট রাইফেল, আর ১০-১৫টি গ্রেনেট। আমাদের কমান্ডার যখন বললেন, ফায়ার। আমরা সবাই একযোগে ফায়ার করি। এতে ভয় পেয়ে পাকবাহিনী থানা ছেড়ে পালিয়ে যায়। বিনা রক্তপাতে আমরা থানা দখল করে ফেলি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনাদের ধর্মীয় অনুভূতি কেমন ছিল? হহ মৃত্যুর কথা নিশ্চিত জেনেই আমরা যুদ্ধে যেতাম। গোসল করে পবিত্র হয়ে যুদ্ধে যেতাম। বিসমিল্লাহ বলে রাইফেলের টিগারে টিপ দিতাম। আক্রমণ করে আমরা তাকবির দিতাম। আমাদের ক্যাম্পের সবাই নামাজি ছিল। কোন কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ করেছেন? ** আমি যুদ্ধ করেছি দুই নম্বর সেক্টরে। আমার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর হায়দার। থানা কমান্ডার ছিলেন কামরুল হাসান ভূঁইয়া। কয়েকজন সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধার নাম বলুন? হহ আঃ ওয়াদুদ, আঃ সাত্তার, আঃ মান্নান, নেপালচন্দ্র সূত্রধর, খোরশেদ আলম, বকবির হোসেন ও ইদ্রিস সরকার। এদের অনেকেই এখনও জীবিত আছে। সনদ পেয়েছেন? ** হ্যাঁ, পেয়েছি। ভাতাও পাচ্ছি। আমার সনদ নং-ম-৮১৫২০। ওসমানী সাহেবেরও সার্টিফিকেট পেয়েছি। যুদ্ধের সময় অস্ত্র, টাকা-পয়সা ও খাবারের জোগান কীভাবে হতো? ** অস্ত্রের বেশিরভাগ পেতাম যুদ্ধ জয় দিয়ে। পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র আমাদের প্রধান সম্বল হয়ে দাঁড়ায়। খাবার এলাকাবাসী খাওয়াত। যে এলাকায় যুদ্ধ করতে যেতাম, সে এলাকার লোকেরা খাবারের ব্যবস্থা করত। আর টাকা-পয়সাও লোকজন দিয়ে যেত। স্বাধীনতার স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছে? ** না, যেমন বাংলাদেশ চেয়েছি তেমনটা পাইনি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার আর কী করতে পারে? হহ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফ্রি চিকিৎসা, ফ্রি ভ্রমণ ব্যবস্থা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় কথা হলো_ বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নষ্ট রাজনীতি চলছে। এসব বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। শাহবাগের গণজাগরণ সম্পর্কে কিছু বলুন? ** শাহবাগে প্রথমে সাধারণ মানুষের আন্দোলন ছিল। পরে এটি অন্য পথে মোড় নেয়। একটি চক্র মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে দাঁড় করাতে চায়। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন মুসলিম। তারা ধর্মপ্রাণ ছিলেন। কেউ ইসলামবিরোধী ছিলেন না। আপনি অবশ্যই দেখেছেন শাহবাগে বঙ্গবন্ধুর ছবি স্থান পায়নি। তারা বঙ্গবন্ধুকে শুধু আওয়ামী লীগের সম্পদ বানিয়ে রেখেছে। অথচ বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা। তার হাত ধরেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তিনি সর্বজনীন নেতা। তিনি যদি এ আন্দোলনে স্থান না পান, তাহলে আর কে পেতে পারেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে কিছু বলুন? ** যুদ্ধাপরাধের বিচার একটি ক্রিটিক্যাল বিষয়। ৪৩ বছর আগের বিচার বর্তমান সময়ে করতে অনেক সচেতন হওয়া প্রয়োজন। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে রাজনীতি করলে একসময় মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে ভুল বুঝবে। তাই যুদ্ধাপরাধের বিচারে সাবধানি হওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু বলুন। ** বঙ্গবন্ধু মহান নেতা, তার নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তিনি ইসলামপ্রেমিক ছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। ওআইসিতে যোগদান করেন। মুসলিমবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে জোরালো ভূমিকা রাখেন। মুসলিমবিরোধী ইসরাইলের সঙ্গে প্রথম থেকেই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত থাকেন। বঙ্গবন্ধু এ দেশের রেডিও-টেলিভিশনে কোরআন তেলাওয়াত করা চালু করেন। তিনি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। আলোকিত বাংলাদেশ : নতুন প্রজন্মের জন্য কিছু বলুন। আবুল কাশেম : নতুন প্রজন্মের সন্তানদের বলতে চাই, তোমরা দেশকে ভালোবাস। স্বাধীনতা অর্জন করা যতটা কঠিন ততটা কঠিন হচ্ছে রক্ষা করা। আজকের বাংলাদেশ গঠনে তোমাদের ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। সর্ব ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হতে হবে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়