Wednesday, December 10

ওরাও তো মানুষ


স্বকৃত নোমান: ঢাকা শহরের পরিবহন শ্রমিকরা যাত্রী কর্তৃক যে লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হয়, তাতে প্রশ্ন জাগে, তারা কি মানুষ নয়? মানুষ বটে। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রা অনেকটা প্রাচীনকালের দাসদের মতো। শত অপমান সহ্য করেও তাদের নির্বিকার থাকতে হয়। সব তাদের সয়ে যেতে হয়। কারণ তারা পরিবহন শ্রমিক। দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক। এক. মীরপুর বড়বাগ থেকে রাস্তাটি পীরেরবাগ হয়ে আগারগাঁওয়ে এসে মিলেছে। নতুন রাস্তা। এখনো বাস চালু হয়নি, পরীক্ষামূলকভাবে জিপ চলছে। বড়বাগ টু ফার্মগেট। এতে এসব এলাকার যাত্রীদের সুবিধা হয়েছে। বড়বাগ থেকে ফার্মগেট আসতে হলে আগে বিশ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে মীরপুর দশ নম্বর গোলচক্কর আসতে হতো। ওখান থেকে বারো টাকা বাস ভাড়া দিয়ে ফার্মগেট। অর্থাৎ পঁয়ত্রিশ টাকা। অথচ জিপে মাত্র পনের টাকা দিয়ে বড়বাগ থেকে ফার্মগেটে আসা যাচ্ছে। সময়ও লাগছে কম। কয়দিন আগে জিপ মালিক সমিতি ভাড়া তিন টাকা বাড়িয়ে আঠারো টাকা করল। বর্ধিত ভাড়ার একটা তালিকাও টাঙিয়ে দিল প্রত্যেক জিপে। কিন্তু যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া মানতে নারাজ। চালকের সহযোগীর সঙ্গে শুরু করল বাকবিত-া। চালকের সহযোগী বারো-তের বছরের একটা ছেলে। যাত্রীরা তার উদ্দেশে এমন খিস্তিখেউড় করছিল, পারলে তাকে গিলে খায়! এমন ভাষায় গালাগালি করছিল যা লেখার অযোগ্য। ছেলেটা বারবারই বলছিল, ‘আপনারা ড্রাইভারকে ধরেন। পেটের দায়ে আমি হেলপারি করি, আমারে গালি দিচ্ছেন কেন?’ কে শোনে তার কথা! সব যাত্রী তার বিরুদ্ধে একাট্টা। তাকে একটা ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়ে তবেই ছাড়বে। এক পৌঢ় যাত্রী ছেলেটিকে যাচ্ছেতাই গালাগালি করে মারতে উদ্যত হলো। তখন আরেক যাত্রী প্রৌঢ়ের উদ্দেশে বলল, ‘ছেলেটি তো আপনার নাতির বয়সী। তার সঙ্গে আপনি যে ভাষায় কথা বলছেন তা আপনার পক্ষে শোভা পায়? অভিযোগ থাকলে আপনি ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলুন।’ প্রৌঢ় হাত গুটিয়ে নিল। কিন্তু মুখ নয়। ফার্মগেট পর্যন্ত তার মুখটা চলতেই থাকল। দুই. বিকেল পাঁচটা। সরকারি-বেসরকারি অফিস ছুটি হয়েছে। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত রাস্তায় প্রচ- জ্যাম। বাসের অপেক্ষায় রাস্তায় অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে। সাভারগামী বাসটি শাহবাগ সিগন্যাল ক্রস করে রাস্তার বাঁ-পাশ ধরে বিএসএমএমইউর সামনে এসে দাঁড়াল। জ্যামের কারণে আর সামনে এগুতে পারছে না। যাত্রীরা হইচই শুরু করে দিল। ড্রাইভারের উদ্দেশে বলল, ‘তুই বাঁ সাইট দিয়ে কেন এলি? ডান সাইট দিয়ে গেলে তো সহজে যেতে পারতি।’ ড্রাইভার নিশ্চুপ। রূপসী বাংলা মোড়ের সিগন্যাল ছাড়ল। বাস চলতে শুরু করল। যাত্রীদের কথা মতো ড্রাইভার বাসটিকে রাস্তার ডান দিকে নিয়ে এলো। মোড়ের কাছাকাছি আসতেই আবার সিগন্যাল পড়ে গেল। অমনি যাত্রীরা আবার হইহই করে উঠল, ‘তুই বেটা ডান দিকে কেন এলি, বাঁ দিকে থাকলে তো এতক্ষণে চলে যেতে পারতি।’ এক যাত্রী বিশ্রী একটা গালি দিল ড্রাইভারের উদ্দেশে। ড্রাইভার নিশ্চুপ। আরেক যাত্রী একটা গালি দিয়ে বলল, ‘ও ড্রাইভার না হেলপার? ওই, তোকে ড্রাইভারি কে শিখিয়েছে?’ ড্রাইভার তবু নিশ্চুপ। বাংলামোটর সিগন্যালে এসে বাসটি থামার পর রাস্তায় অপেক্ষমাণ কয়েকজন যাত্রী ঠেলাঠেলি করে উঠে পড়ল। চালকের সহযোগী বারবার নিষেধ করছিল, কিন্তু বাসের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষমাণ যাত্রীরা কি তার কথা পাত্তা দেয়! ধাক্কাধাক্কি করে সবাই উঠল। তাতে ভেতরের যাত্রীরা গেল ক্ষেপে। ড্রাইভার ও হেলপারের উদ্দেশে আবার শুরু হলো গালাগালি, খিস্তিখেউড়, ‘এটা কি লোকাল বাস? ভাড়া তো নিয়েছিস ডাইরেক্ট বলে। এখন যাত্রী ওঠাচ্ছিস কেন?’ ড্রাইভার ও হেলপার তবু নিশ্চুপ। নিশ্চুপ, কারণ তারা পরিবহন শ্রমিক। তাদের নিশ্চুপ থাকতে হয়। এসব তাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। জানি না পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে প্রাচীনকালের দাসদের মতো পরিবহন শ্রমিকদের এত খারাপ ব্যবহার করা হয় কি না। বাংলাদেশে হয়। বিশেষ করে ঢাকা শহরে। শুধু মীরপুর বা সাভারের বাস শ্রমিকরা নয়, ঢাকা শহরের প্রতিটি রুটের পরিবহন শ্রমিকদের প্রতিদিন এমন গালাগালি-খিস্তিখেউড় হজম করতে হয়। তীব্র গরমের মধ্যে, দীর্ঘ যানজট ঠেলে ড্রাইভার বাসটি চালিয়ে নিচ্ছে। এমন গরম বা যানজটের মধ্যে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার কথা। বাসচালকদের মেজাজও কি বিগড়ায় না? কিন্তু তার মেজাজের ধার ধারে কে? যেসব যাত্রী তাকে গালি দিচ্ছে, তাদের একজনকে ধরে যদি তার আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়, আমি নিশ্চিত সে একটা গালিও হজম করতে পারবে না। প্রয়োজনে রক্তারক্তি হয়ে যাবে, তবু সে গালির পাল্টা নিয়ে ছাড়বে। আমরা যাত্রীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছি, অথচ আমাদের বাজে স্বভাবগুলো দূর করতে পারছি না। আমাদের মধ্যে ধৈর্য এবং সহ্যবোধটা নেই। অথচ ড্রাইভার বা হেলপারদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুব বেশি লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি, অথচ তাদের ধৈর্য-সহ্যের মাত্রা দেখে বিস্মিত হতে হয়। যানবাহনে চলাচলে শুধু ড্রাইভার-হেলপারদের দোষ দিলে হবে না, দোষ আমাদেরও আছে। যাত্রীভরপুর একটা বাসে ঠেলাঠেলি করে আমরা কেন উঠি? বাসস্টপেজ ছাড়া যত্রতত্র আমরা কেন উঠি, কেন নামি? দায় কি আমাদের নেই? বাসে চড়ে বসলে আমাদের মনুষ্যত্ববোধটা যেন কোথায় উধাও হয়ে যায়। তাই আমরা পরিবহন শ্রমিকদের মানুষ মনে করি না। এটা উচিত নয়। এ কথা খেয়াল রাখতে হবে, তারাও আপনার-আমার মতো মানুষ। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়