Wednesday, December 24

কাশ্মীর-উপত্যকার-বিধবাদের-দুঃখগাঁথা


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক : ১৯৮৯ সালের সশস্ত্র বিদ্রোহের পর থেকে শুরু করে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে ভারতের সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাশ্মীরের ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের সংঘর্ষ প্রশমিত হয়ে আসলেও অসংখ্য বিধবা এখনো ওই সংঘর্ষের ক্ষত চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। বিবিসি হিন্দি বিভাগের প্রতিবেদক শালূ যাদব তুলে এনেছেন এমনই দুই কাশ্মীরি বিধবার দু:খগাঁথা। কাশ্মীর উপত্যকার বিধবাদের দুঃখগাঁথা রাফিকা মালিক, এক নিহত জঙ্গির বিধবা স্ত্রী ওই সংঘর্ষে নিহত হওয়া গোলাম নবী মালিক নামে এক বিদ্রোহীর জঙ্গির বিধবা স্ত্রী রাফিকা মালিক বলেন, আমার স্বামী পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি ছিলেন। তিনি প্রতিদিন ৩ ডলার আয় করতেন। আমাদের পরিবার ছিল একটি সুখী পরিবার। আমারা পরস্পরকে অনেক ভালোবাসতাম। সে আমাকে তার প্রথম স্ত্রীর চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসতো। ১৯৯০ এর দশকে এসে কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে উঠে। আমাদের গ্রাম বিন্দিপুরের প্রতিটি ঘরে একজন করে জঙ্গি ছিল। আমাদের বিয়ের ১০ বছর পরে ১৯৯০ সালে আমার স্বামী গোলাম নবী হঠাৎ করেই একদিন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান। এরপর একমাস ধরে আমি তাকে পাগলের মতো খুঁজতে থাকি। পরে আমি জানতে পারি সে সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানে চলে গেছে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য। আমি আরও জানতে পারি সে ভারতবিরোধী একটি ইসলামি জিহাদি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এরপর আমি তাকে বাড়ি ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে অনেকগুলো সংবাদ পাঠাই। কিন্তু সে তার কোনো উত্তর দেয়নি। একবছর পর হঠাৎ একদিন সে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু সে বাড়িতে বেশিক্ষণ ছিল না। তার সঙ্গে সব সময়ই একটি বন্দুক থাকতো। সে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতো। আমি তাকে বন্দুক ত্যাগের জন্য কনভিন্স করার চেষ্টা করি। কিন্তু সে আমাকে বলে, ‘আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে পারলেও বন্দুক ছাড়তে পারবো না। আমি একটি বিশেষ আদর্শিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের জন্য হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছি। আমাকে এখন তা নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’ রাফিকা বলেন, আমি এমনকি তাকে তালাক দেওয়ার হুমকিও দিই। কিন্তু এরপরও সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। তার সঙ্গে আমার সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয় ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে হেমন্তের এক শীতার্ত রাতে। সেদিন মধ্যরাতে সে বাড়ি এসেছিল। প্রতিদিনের মতো সে রাতেও তার সঙ্গে আমার বাক-বিতণ্ডা হয়। আমি তাকে খাবার খাওয়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে রাগান্বিত হয়ে রাত ৩টার দিকে বাড়ি ত্যাগ করে। এরপর ২৫দিন পর্যন্ত তার কোনো হদিস পাইনি আমি। ২৫ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক বন্দুকযুদ্ধে সে নিহত হয়। আমি তখন গর্ভবতী ছিলাম। আমার পেটে তখন আমাদের চতুর্থ সন্তান। এ কারণে আমাকে তার চেহারাটি শেষবারের মতো দেখার সুযোগও দেওয়া হয়নি। গ্রামের লোকদের ধারণা ছিল, আমি যদি আমার স্বামীর মৃতদেহ দেখি তাহলে তা আমার গর্ভের সন্তানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে! তারা আমাকে জানিয়েছিল যে আমার স্বামীর পুরো মুখমণ্ডল বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। আমি তার জঙ্গিপনার প্রতি কোনো সমর্থন প্রদর্শন করিনি। কিন্তু তাকে নিয়ে আমি গর্বিত। সে শহীদের মৃত্যু বরন করেছে। তার দাফনও করা হয়েছে শহীদদের জন্য নির্ধারিত গোরস্থানে। গ্রামের লোকেরা তার জন্য আমাকে সম্মান প্রদর্শন করে। আমি তাকে এখনো অনেক মিস করি। আমরা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমাদের কেউ একজন মরে গেলেও আমরা আর অন্য কাউকে বিয়ে করবো না। আমি আমার প্রতিজ্ঞা পালন করেছি। আমি তার মৃত্যুর পর আর কাউকে বিয়ে করিনি। কাশ্মীর উপত্যকার বিধবাদের দুঃখগাঁথা গুলশান আখতার, এক নিহত সৈনিকের বিধবা স্ত্রী অন্যদিকে আব্দুল হামিদ চারা নামে ভারতের রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর এক নিহত সৈনিকের বিধবা স্ত্রী গুলশান আখতার জানান, খুবই তরুণ বয়সে তারা পরস্পরের প্রেমে পড়েন এবং বিয়ে করেন। বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল ১৩ আর আমার স্বামীর বয়স ছিল ১৭, বলেন গুলশান আখতার। বিয়ের সময় আমার স্বামী আব্দুল হামিদ চারা ভারতবিরোধী ইসলামপন্থী জঙ্গি ছিলেন। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরই তিনি ভারতের সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দেন। আত্মসমর্পণের পর তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে জঙ্গিদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে শুরু করেন। এরপর ২০০৩ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সবসময়ই একটি সম্মানজনক পেশায় কাজ করতে চাইতেন। আর সেনাবাহিনীতেই তিনি সে কাজটি খুঁজে পান। সেনাবাহিনীর প্রতি তার আত্মোৎসর্গ ছিল অতুলনীয়। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি জাতির উপকারের জন্য নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে প্রস্তুত আছি।’ সৈনিকদের স্ত্রীদের জীবন খুবই কঠিন। আমার স্বামী বছরে মাত্র দুইবার ছুটিতে বাড়ি আসতেন। তিনি যখনই কোনো সেনা অভিযানে যোগ দিতে যেতেন আমি তার প্রাণহানির শঙ্কায় দিন কাটাতাম। ২০০৭ সালের জুন মাসের একটি রাতের কথা আমি কখনোই ভুলবো না। সেসময় আমার গর্ভে ছিল আমাদের পঞ্চম সন্তান। একদিন আমি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়লে, তিনি ছুটি নিয়ে দ্রুত বাড়ি চলে আসেন এবং আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসার পরদিনই সেনাবাহিনীতে তার নিজস্ব ইউনিট থেকে জরুরি কল আসে। তাকে পরদিনই কাজে যোগ দিতে বলা হয়। লোলাব উপত্যকায় জড়ো হওয়া একদল জঙ্গির বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে যোগ দেওয়ার জন্য পাঠানো হয় তাকে। আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম সে যেন ওই অবস্থায় আমাকে ছেড়ে না যায়। কিন্তু তিনি সেনাবাহিনীর প্রতি এতোটাই আত্মোৎসর্গীকৃত ছিলেন যে, আমার কথায় কোনো কান দেননি। ওই অভিযানেই তিনি নিহত হন। তিনদিন পর সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে তার মৃতদেহ নিয়ে আসা হয়। সরকার তাকে একটি মরোণোত্তর বীরত্বের পুরস্কার ও খেতাবে ভুষিত করে। জাতির উপকারের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমি তার জন্য গর্বিত। কিন্তু তাকে ছাড়া আমার এবং আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী। রাষ্ট্রের দিক থেকে তার মৃত্যু ছিল গৌরবজনক। কিন্তু সমাজে আমি সম্মান হারাই। কারণ আমি একজন মুসলিম বিধবা। আমাদের সমাজে মুসলিম নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করতে যাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু এছাড়া আমার আর কোনো উপায়ও ছিলো না। পরিবারের টুকিটাকি কেনাকাটা ও কাজের জন্য আমাকে প্রায়ই ঘরের বাইরে যেতে হয়। কিন্তু আমি যখন বাজারে যাই তখন লোকে পেছনে পেছনে আমাকে নিয়ে খুব বাজে সব মন্তব্য করে। কাশ্মীর নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ইসলামপন্থী জঙ্গিদের সংঘর্ষে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু কাশ্মীর সংকটের কোনো সমাধানই আসেনি এখনো। এই সংঘর্ষের সবচেয়ে বড় ফল হল স্বামী হারিয়ে অসংখ্য নারীর বিধবা হওয়া। কাশ্মীর উপত্যকায় এখন নিহত সেনা সদস্য ও জঙ্গি সদস্যদের অসংখ্য বিধবা স্ত্রীদের বসবাস রয়েছে। গুলশান আখতার বলেন, আমাদের পুরুষরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের জীবন খোয়াচ্ছে। কিন্তু তারা কি পেছনে রেখে যাওয়া নিজেদের পরিবার সম্পর্কে একটিবারও ভেবে দেখেছে যে তাদের মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা কতটা দুর্দশার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে?

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়