Saturday, November 15

মানুষখেকো বাঘের মুখোমুখি...


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত পৃথীবির সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে বাস করে প্রায় ৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রজাতির বাঘ। তবে এই এলাকায় প্রায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষেরও বসবাস রয়েছে। প্রতি বছর এ বনের বাঘেরা অন্তত ৬০ জন মানুষকে আক্রমণ করে থাকে। আর আক্রান্তদের অল্প কয়েকজনই বাঘের আক্রমণ থেকে বেঁচে ফিরে আসেন ওই বাঘের নৃশংসতার গল্প বলার জন্য। সুন্দরবন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের মন ও হৃদয়ে বাঘ শব্দটির চেয়ে আর কোনও শব্দই এতো বেশি আতঙ্কের সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। এমনকি এই শব্দটির সামান্য ইঙ্গিতেই সুন্দরবনের আশে-পাশের গ্রামের বাসিন্দারা হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে দেন। ২০০৬ এবং ২০০৮ সালের মধ্যে সুন্দরবন সীমান্ত ঘেঁষে পশুর নদীর তীরে অবস্থিত জয়মনি নামে ছোট্ট গ্রামটির বেশ কয়েকজন মানুষ বাঘের হামলার শিকার হয়ে নিহত হন। এরকমই একটি হামলার সময় একটি বাঘ মধ্যরাতে ওই গ্রামের এক কুড়ে ঘরের বাঁশের বেড়া ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে ৮৩ বছর বয়সী এক বৃদ্ধাকে ছিনিয়ে নেয়। এসময় তার ৭০ বছরের কাছাকাছি বয়সী সন্তান কৃষ্ণপদ মন্ডল মায়ের আর্তনাদ শুনতে পান। মানুষখেকো বাঘের মুখোমুখি... কৃষ্ণপদ মায়ের আর্তনাদে ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন তার মা মারাত্মক জখম ও রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছেন। তার পোশাক-পরিচ্ছেদ সব ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতেই কৃষ্ণপদ বলছিলেন, ‘বাঘটি আমার মায়ের মাথার বাম পাশে কামড় বসিয়েছিল। এতে তার মাথার খুলি ভেঙ্গে গিয়েছিল। তিনি তখনও শ্বাস নিচ্ছিলেন, কিন্তু তার চেতনা ছিল না।’ কৃষ্ণপদ বলেন, ‘মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ওই রাতের ঘটনা আমার মনে থাকবে। ওই ঘটনার কথা মনে পড়লে আমি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। আমি এখনও আমার মায়ের ওই করুণ আর্তনাদ শুনতে পাই।’ সুন্দরবনের বেশিরভাগ মানুষই বেঁচে থাকার জন্য বন ও নদী থেকে আহরিত খাদ্যের উপর নির্ভর করেন। তারা বন থেকে আহরিত মধু ও নদীর মাছ ধরে তা বিক্রি করে আয়-রোজগারও করে থাকেন। এমনকি অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও অনেকে বনের সংরক্ষিত অঞ্চলে ঢুকে পড়ে জ্বালানি কাঠ আহরণ ও বণ্যপ্রাণী শিকারে লিপ্ত হন। আর এতেই তারা বাঘের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। চলতি বছরের গ্রীষ্মকালেও দুটি ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় মাছ ও কাঁকড়া শিকার করতে গিয়ে দুই ব্যাক্তি নিহত হন। এভাবেই বনে প্রবেশ করে জামাল মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি তিন তিনবার বাঘের কবলে পড়েও প্রাণে বেঁচে ফিরে আসতে সক্ষম হন। তিন তিনবার বাঘের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হওয়ায় জামাল সুন্দরবন এলাকায় এখন এক জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন। মানুষখেকো বাঘের মুখোমুখি... শেষবারের হামলার অভিজ্ঞতা বর্ননা করতে গিয়ে জামাল বলেন, দুইবারের হামলায় বেঁচে আসার পর আমি বুঝে গিয়েছিলাম বাঘেরাও মানুষকে ভয় পায়। ফলে এবার আমি বাঘের মুখোমুখি হই লড়াই করার জন্য। আমিও বাঘটিকে পাল্টা হুঙ্কার দিয়ে উঠি, চোখমুখ যতটা সম্ভব বিকৃত করে প্রচুর শব্দ সৃষ্টি করি। এভাবে প্রায় আধাঘন্টা ধরে বিকট চিৎকার-চেচামেচি করার পর বাঘটি ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। আমার গলা দিয়ে প্রায় রক্ত বের হয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল। আর ইতোমধ্যে আমার স্ত্রীও আমার চিৎকার-চেচামেচি শুনে গ্রামের লোকদের জড়ো করে বাঘটিকে তাড়ানোর জন্য চিৎকার শুরু করে দিয়েছিল। আর আজকাল সুন্দরবনের বাঘগুলো বিশ্বের অন্য যে কোনও বনের চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র হয়ে উঠছে বলেই মনে হচ্ছে। অনেকের ধারণা সুন্দরবনের নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি অতিরিক্ত লবনাক্ত হয়ে পড়ায় এমনটা ঘটছে। তবে বাঘগুলোর এমন হিংস্র হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ মনে হয় তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থলের আয়তন সংকুচিত হয়ে আসা এবং তাদের খাদ্য ঘাটতি দেখা দেওয়া। কারণ বনের আশে-পাশেই আরও অন্তত ১০ লাখ মানুষের বসবাস। উভয়েই তাদের জীবন-জীবিকার জন্য পুরোপুরি বনের উপরই নির্ভর করে। ফলে সুন্দরবন এলাকায় খাদ্য ঘাটতির সমস্যাটি মানুষ ও বাঘ উভয়ের জন্যই সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। এতে বাঘ ও মানুষ পরস্পরের আবাসস্থল ও খাদ্যের উপর হানা দিতে বাধ্য হয়। বন সংরক্ষণবাদিদের এক জরিপে দেখা গেছে, সুন্দরবনের পাশে অবস্থিত একটি গ্রামে প্রতিবছর কুকুর, ছাগল, মহিষ এবং গরুর মতো অন্তত ৮০টি গৃহপালিত পশু বাঘের পেটে যায়। এর ফলে গ্রামবাসীরাও বেশ কয়েকটি বাঘের উপর পাল্টা হামলা চালায়। কিন্তু বাঘের উপর পাল্টা হামলা বন্ধে ২০০৮ সালে স্থানীয় বন সংরক্ষণবাদিরা ৪৯টি টাইগার ভিলেজ রেসপন্স টিম গঠন করে। মানুষখেকো বাঘের মুখোমুখি... এদের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্রামে হানা দেওয়া বাঘগুলোকে না মেরে বরং ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে বনের ভেতরে ফেরৎ পাঠানো। বাঘকে ভয় দেখাতে মশাল জ্বালিয়ে বা বিশাল অগ্নিকুন্ড সৃষ্টি করার পদ্ধতি অবলম্বনের কথা বলা হয়। এ পদ্ধতি যদি ব্যার্থ হয় তাহলে পুলিশের সোয়াত টিমকে খবর দেওয়ার জন্য তাদের কাছে একটি ফোন নম্বর দেওয়া হয়। সোয়াত টিমের সদস্যরা এসে হানাদার বাঘটিকে সাময়িক চেতনা নাশক দিয়ে অজ্ঞান করে বনে রেখে আসার কথা বলা হয়। তবে এরপরও মানুষ হত্যার প্রতিশোধ নিতে বাঘ হত্যার ঘটনা থামেনি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঘাঘড়া মারি ফরেস্ট স্টেশনের পাশের গ্রামের বাসিন্দারা একটি বাঘকে হত্যা করে। বাঘটিও এর আগে গ্রামটির এক বাসিন্দাকে হত্যা করেছিল। প্রজাতি হিসেবে বাঘ একদিন প্রাণীজগৎ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, স্থানীয় বাসিন্দারা এমনটা বিশ্বাসই করতে চান না। দেবেন মন্ডল নামে এক জেলে এমনটা শুনে অপার বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করেন, এটা কীকরে সম্ভব যে এমন একটি হিংস্র প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে? তিনি আরও বলেন, আমি বাঘের হৃদস্পন্দন শুনেছি। আর তা আমার চেয়েও অনেক শক্তিশালি। দেবেন জানান, সুন্দরবনের কুলতলি খাল এলাকায় একবার তিনি ও তার কয়েকজন সঙ্গী মাছ শিকারে গিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ভোর বেলা। দেবেন তার জাল খালে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই পাশের ঝোপের আড়াল থেকে একটি বাঘ তার উপর লাফিয়ে পড়ে। দেবেন বলেন, বাঘটি এতটাই উচ্চস্বরে গর্জন করছিল যে, আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন বজ্রপাত হচ্ছে। এই বলে দেবেন বাঘের মতোই গর্জন করছিলেন। দেবেন আরও বলেন, আমি পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। বাঘটির ওজন এতো বেশি ছিল যে, আমার মনে হচ্ছিল যে আমি কাঁদার মধ্যে দেবে যাবো। সূতরাং আমি বাঘটির ঘাড় খামচে ধরি। এবং সেটির বুকে আমি মাথা গুঁজে রাখি। এসময় আমি বাঘটির হৃদস্পন্দন শুনতে পাই। আমি আমার কান দু’টো বাঘটির বক্ষে চেপে ধরি। মাথায় বাঘটির গরম শ্বাস-প্রশ্বাসও অনুভব করছিলাম আমি। মানুষখেকো বাঘের মুখোমুখি... আমি ভেবেছিলাম যে, যদি আমি ওভাবেই বাঘটিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারি তাহলে হয়তো সেটি আমাকে কামড়াতে সক্ষম হবে না। কিন্তু বাঘটি আমাকে আছাড় মারতে থাকে। এক পর্যায়ে আমি ছিটকে পড়ি এবং বাঘটি আমার ঘাড়ে একটি কামড় বসিয়ে দেয়। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি আর বাঁচবো না। দেবেন জানান এসময় তার সঙ্গে থাকা দুইজনের একজন ভয়ে গাছে চড়ে বসে। তবে অন্যজন তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে। দেবেন বলেন, আমার এক সঙ্গী একটি কুঠার বা লম্বা কাঠের লাঠি নিয়ে আমাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। সে ওই কুঠার বা কাঠের লাঠি নিয়ে বাঘটির মাথায় জোরে আঘাত করে। মাথায় আঘাত পেয়ে বাঘটি আমাকে ফেলে দিয়ে বনের ভেতর পালিয়ে যায়। সুকুমার নামে আরেক গ্রামবাসী জানান, তিনি আরও মারাত্মক শারীরিক জখমে ভুগছেন। বাঘের দাঁতে পিষ্ট হয়ে তার মুখমন্ডল একদিকে বেঁকে গেছে। এর ফলে তিনি এখন আর ঠিকমতো চোখে দেখতে পান না, কানেও শুনতে পান না। এমনকি পরিস্কার করে কথাও বলতে পারেন না। সুকুমার জানান, এক নারী তাকে বাঘের কবল থেকে মারাত্মক আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন। বাঘটি যখন তাকে কামড়ে দাঁত দিয়ে পিষ্ট করছিল তখন তার আর্তনাদে এক নারী এগিয়ে আসেন। ওই নারী একটি শক্ত কাঠের লাঠি দিয়ে শরীরের সর্বশক্তি নিয়ে বাঘটির মাথায় আঘাত করেন। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে খুলনার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক সপ্তাহের চিকিৎসায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেলেও তিনি কর্মক্ষমতা হারান।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়