আলী হাসান তৈয়ব
রাসূল (সা.) এর সৌভাগ্যবান নাতি-নাতনি আটজন। নাতিরা হলেন_ আলী, মুহসিন, হাসান, হোসাইন ও আবদুল্লাহ। নাতনিরা হলেন_ উমামা, উম্মে কুলসুম ও জয়নব। উল্লেখ্য, মহানবী (রা.) এর কোনো ছেলে সন্তানই বিয়ে করার মতো বয়স পায়নি। সবাই অপ্রাপ্ত বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। সেহেতু মহান আল্লাহ নবীবংশের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন তার মেয়েদের মাধ্যমে। যারা মেয়েদের অবহেলা করেন, মেয়ের জন্মে অখুশি হন এবং তাদের বংশের প্রদীপ জ্ঞান করেন না, তারা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। আল্লাহ বলেন, 'যখন তাদের কাউকে মেয়ে শিশুর সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তাদের মুখ কালো হয়ে যায় এবং অসহ্য মনস্তাপে ক্লিষ্ট হতে থাকে।' (সূরা নাহল : ৫৮)।
জয়নবের ঘরে : নবী (সা.) এর বড় মেয়ে জয়নবের বিয়ে হয়েছিল খালাতো ভাই আবুল আস বিন রবির সঙ্গে। তাদের ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। ছেলের নাম ছিল আলী। তিনি শিশুকালেই মারা যান। মেয়ে ছিলেন উমামা। তাকে মহানবী (সা.) অত্যন্ত আদর করতেন। প্রিয় নাতনিকে নিজের পিঠে তুলে নিতেন। ফাতেমা (রা.) এর মৃত্যুর পর আলী (রা.) তাকে বিয়ে করেন। (ইবনে কাসির, বেদায়া ওয়ান নিহায়া)।
রুকাইয়ার ঘরে : রুকাইয়া (রা.) এর বিয়ে হয় ওসমান (রা.) এর সঙ্গে। স্বামী-স্ত্রী হাবশায় হিজরত করলে সেখানে তাদের একমাত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে, যার নাম ছিল আবদুল্লাহ। এজন্য ওসমান (রা.) কে আবু আবদুল্লাহ উপনামেও ডাকা হতো। মাত্র ছয় বছর বয়সে তার চোখে মুরগি ঠোকর মারে। আবদুল্লাহর চোখ-মুখ ফুলে যায় এবং ক্রমশ তা মারাত্মক রূপ নেয়। অবশেষে চতুর্থ হিজরির জমাদিউল উলা মাসে তিনি মদিনায় মারা যান। তার কবরে নামেন নানা মুহাম্মদ (সা.) ও বাবা ওসমান (রা.)। মায়ের মৃত্যুর দুই বছরের মাথায় তারও মৃত্যু ঘটে। (উসুদুল গাবা : ৫/৪৫৬)।
উম্মে কুলসুমের ঘরে : সহোদরা রুকাইয়ার মৃত্যুর পর উম্মে কুলসুমের বিয়ে হয় ওসমান (রা.) এর সঙ্গে। নবম হিজরিতে তার মৃত্যু হয়। শোকাচ্ছন্ন মনে মহানবী (সা.) বোন রুকাইয়ার কবরে মদিনার জান্নাতুল বাকিতে তাকে কবরস্থ করেন। তাদের ঘরে কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি।
ফাতেমার ঘরে : ফাতেমা (রা.) এর বিয়ে হয় মহানবী (সা.) এর চাচাতো ভাই আলী (রা.) এর সঙ্গে। তাদের ঘরে পাঁচ সন্তানের জন্ম হয়। তিন ছেলে হাসান, হোসাইন ও মুহসিন এবং দুই মেয়ে উম্মে কুলসুম ও জয়নব। (ইবনে কাসির, বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। এদের মধ্যে মুহসিন শিশুকালেই মারা যান।
জয়নব বিনতে আলী : তার জন্ম সাল সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত। তাকে বড় জয়নব বলা হতো। তিনি ৬২ আবার কারও মতে ৬৫ হিজরির ১৫ রজব ইন্তেকাল করেন। জয়নব বিনতে আলী সম্পর্কে শিয়া মতবাদ প্রভাবিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও চলচ্চিত্রে বহু ঘটনা এবং তথ্য প্রচলিত রয়েছে, যার কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র নেই।
উম্মে কুলসুম বিনতে আলী : ফাতেমা ও আলী (রা.) দম্পতির পঞ্চম সন্তান তিনি। তাকে ছোট জয়নবও বলা হয়। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতানুযায়ী নানা মহানবী (রা.) এর জীবদ্দশাতেই তার জন্ম। তিনি রাসূল (রা.) এর সৌভাগ্যময় আদর-পরশ পেয়েছেন। তবে তার থেকে কোনো হাদিস বর্ণনা করেননি। বলা হয় প্রাপ্ত বয়সে তিনি কোরাইশের শ্রেষ্ঠ সুসাহিত্যিক মেয়ে হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ১৭ হিজরিতে ওমর বিন খাত্তাব (রা.) এর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তার গর্ভে ওমর (রা.) এর দুই সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। জায়েদ বিন ওমর বিন খাত্তাব ও রুকাইয়া বিনতে ওমর বিন খাত্তাব। তিনি মারা গেলে তার বিয়ে হয় চাচাতো ভাই মুহাম্মদ বিন জাফর বিন আবু তালেবের সঙ্গে। (জাহাবি, সিয়ারু আলামিন নুবালা)।
হাসান বিন আলী (রা.) : হাসান (রা.) তৃতীয় হিজরির ১৫ রমজানের রাতে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। মহানবী (সা.) জন্মের পর তাকে কোলে তুলে নিয়ে বাম কানে একামত দেন। অতঃপর একটি দুম্বা কোরবানি করেন এবং তার মাথার চুল কামিয়ে সে চুলের ওজনে রুপা দরিদ্র ও অভাবীদের মাঝে বিতরণ করেন। তখন থেকেই মাথার চুলের ওজনে সদকা দেয়া ও আকিকা করা একটি সুন্নতে পরিণত হয়। তিনি শৈশবের সাতটি বছর নানা মুহাম্মদ (সা.) এর সানি্নধ্যে কাটিয়েছেন। মহানবী (সা.) তাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি তাকে কাঁধে নিয়ে বলতেন, 'হে আল্লাহ, আমি একে ভালোবাসি, যে একে ভালোবাসে তাকেও ভালোবাসি।' (বোখারি : ২০১৬) রাসূল (সা.) আরও বলেন, 'হাসান ও হোসাইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার।' (তিরমিজি : ৩৭৬৮) ৪৯ মতান্তরে ৫০ হিজরিতে ৪৭ বছর বয়সে বিষ প্রয়োগে তাকে শহীদ করে দেয়া হয়। তাকে মদিনার জান্নাতুল বাকিতে জননী নবীনন্দিনী ফাতেমা (রা.) এর কবরের পাশে দাফন করা হয়।
হোসাইন বিন আলী (রা.) : চতুর্থ হিজরির শাবান মাসে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নবীগৃহে লালিত-পালিত হয়েছেন। নবী (সা.) তার জন্মগ্রহণে অত্যন্ত আনন্দিত হন। যেখানে যেতেন তিনি তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। প্রিয় নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। কপাল ও থুতনিতে হাত রেখে গভীর মমতায় চুমু খেতেন। হোসাইন (রা.) ছিলেন শৌর্য-বীর্যে পিতার যোগ্য উত্তরসূরি। ছিলেন বিরল আল্লাহভীরু, দানশীল, ইবাদতগুজার ও ধীশক্তিসম্পন্ন। নানা মহানবী (সা.) এর বেশ কিছু হাদিস তার সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। ৬১ হিজরিতে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে নিষ্ঠুর ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে তিনি ৭৩ সঙ্গী-সাথী ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সত্যের পক্ষে এক ঐতিহাসিক লড়াইয়ে শাহাদাত লাভ করেন। তার শির মোবারকের দাফনস্থান দামেস্ক, কায়রোসহ বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। তবে তাফসির ও ইতিহাসবিদ আল্লামা ইবনে কাসির ও পর্যটক ইবনে বতুতা কায়রোয় থাকার মতটিকে শুদ্ধতর বলেছেন।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়