Sunday, October 26

সকলের তরে সকলে আমরা


সৈয়দ শামছুল হুদা ইসলামের অন্যতম একটি সৌন্দর্য হলো_ সব কাজে অন্যকে প্রাধান্য দেয়া। আমাদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সবক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য। রাসূল (সা.) এর আদর্শ থেকে, তাঁর জীবনী থেকে, তাঁর সিরাত থেকে এটা জানা যায় যে, রাসূল (সা.) বড়দের সম্মান করতে বলেছেন, অন্যকে প্রাধান্য দিতে বলেছেন। সাহাবাদের অসংখ্য ঘটনা থেকে জানা যায় যে, তারা বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে সব সময় অন্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধের সেই বিখ্যাত ঘটনা আমরা অনেকেই জানি। নিজের জীবন-প্রদীপ নিভু নিভু অবস্থায় সামান্য পানির জন্য যখন আপন ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম ঠিক সেই সময়েও প্রান্ত থেকে যখন আওয়াজ এলো_ পানি, পানি। তখন তারা নিজের কথা ভুলে গেলেন, অপর ভাইয়ের কাছে পানি নিয়ে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলেন। এভাবে পরপর তিনজন সাহাবি পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন, কেউই আর পানি পান করতে পারলেন না, সবাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। কিন্তু মানুষের জন্য রেখে গেলেন অমর শিক্ষা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি খাবারের ঘটনা, যেখানে আগন্তককে পেটপুরে খাওয়ানোর জন্য মদিনার এক সাহাবি বাতি নিভিয়ে দিলেন, মেহমান যেন তৃপ্তি সহকারে খায়, অথচ নিজেদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। মদিনার সাহাবিদের এ ত্যাগকে আল্লাহ তায়ালা কবুল করলেন, প্রশংসা করলেন। পবিত্র কোরআনে আয়াত নাজিল করলেন। সূরা হাশরের ৯নং আয়াতে বলা হয়েছে, '...এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তারা মুহাজিরদের অগ্রাধিকার দান করে, আর যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।' এ প্রসঙ্গে তাফসিরে মারেফুল কোরআন (সংক্ষিপ্ত) ১৩৫৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে যে, আনসাররা নিজেদের ওপর মোহাজিরদের অগ্রাধিকার দিতেন, নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর আগে তাদের প্রয়োজন মেটাতেন; যদিও নিজেরা অভাবগ্রস্ত ও দারিদ্র্যপীড়িত ছিলেন। আনসারদের আত্মত্যাগ ও আল্লাহ তায়ালার পথে সবকিছু বিসর্জন দেয়ার কথা বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে যে, যারা মনের কার্পণ্য থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে, তারাই আল্লাহ তায়ালার কাছে সফলকাম। আজ আমরা মনের কার্পণ্যে জর্জরিত। আমরা কোনো কাজে অপর ভাইকে প্রাধান্য দিতে পারি না। আর এ কারণে দেখা দেয় নানা বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা। রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনায় আমরা পড়ি। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমরা দেখি। আমরা যদি অন্যকে প্রাধান্য দেয়ার, তাদের সম্মান দেখানোর মহৎ অভ্যাসটি অর্জন করতে পারতাম, তাহলে এসব অনেক ঘটনাই এড়ানো যেত। যে বড় তাকে সম্মান দেয়া ইসলামের শিক্ষা। সব কাজে প্রাধান্য দেয়া হলো তাকে সম্মান জানানো। এ বড়ত্বের ব্যাখ্যা অনেক ব্যাপক। একজন মানুষ শিক্ষায় বড় হতে পারেন, অভিজ্ঞতায় বড় হতে পারেন, বয়সে বড় হতে পারেন, পদমর্যাদায় বড় হতে পারেন, দ্বীনের পথে ত্যাগের ক্ষেত্রে বড় হতে পারেন। তাকে তার সেই বড়ত্বকে স্বীকৃতি দেয়া, সম্মান দেখানো। এটাকেই দাওয়াত ও তাবলিগের পরিভাষায় 'ইকরামুল মুসলিমিন' বলা হয়। একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া। খাওয়ার সময় বড়দের থেকে শুরু করা, চলার সময় মুরুবি্বদের প্রাধান্য দেয়া, কথা বলার সময় তাদের সমীহ করে কথা বলা, তাদের আগে কথা বলতে সুযোগ দেয়া_ এটা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। সূরা নিসার ৩৬নং আয়াতে মানুষের ওপর কতিপয় অবশ্য পালনীয় নির্দেশ করেছেন, এ ব্যাপারে এরশাদ হচ্ছে_ 'তোমরা ইবাদত করো আল্লাহর, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার করো মাতাপিতার সঙ্গে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে, এতিম, অনাত্মীয়, প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সঙ্গী, মুসাফির এবং তোমাদের অধীনস্থদের সঙ্গে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের যারা দাম্ভিক ও অহঙ্কারী।' এ আয়াত দ্বারা এটা খুব পরিষ্কার যে, আমরা কোথায় কার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করব। রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে, অফিস-আদালতে কাজ করতে গিয়ে অপরকে প্রাধান্য দেয়া, তার কাজে সহযোগিতা করা, তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা পবিত্র কোরআনের নির্দেশ। হোক সে আমার পরিচিত, অথবা অপরিচিত। তাকে সম্মান করা, তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, তিনি এরশাদ করেন, রাসূল (সা.) বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি তার ভাইকে সম্মান করল, সে যেন তার প্রভুকেই সম্মান করল। (মুসনাদে আল বাজ্জার : ২০০৬)। মানুষ হিসেবে সবাইকে সম্মান করা ইসলামের যেমন বিধান, তার পাশাপাশি কোনো মুসলমান ভাইকে সম্মান করা, রাস্তাঘাটে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, সর্বত্র তাকে প্রাধান্য দেয়া ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশ। এখন প্রশ্ন আসে, কেন আমরা মানুষকে সম্মান করব? মানুষকে সম্মান করার দ্বারা নিজের গোনাহ মাফ হয়, জান্নাতে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়, আল্লাহ তায়ালার প্রতি বান্দার ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। আসুন আমরা সব কাজে অপর ভাইকে প্রাধান্য দিই। তাহলে আমাদের কাজের মধ্যে বরকত হবে। অন্তরের মধ্যে এক ধরনের সুখ অনুভব হবে। কামিনী রায়ের বিখ্যাত 'সুখ' কবিতায় তিনি এটাই বলেছেন। 'আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনি পরে_ সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।' ওই কবিতাটিতে ইসলামের মৌলিক কথাগুলোই বলা হয়েছে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়