Friday, October 24

ফেনীতে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ-বেত, বেকার হচ্ছে কুটির শিল্পীরা


আবদুল্লাহ আল-মামুন, ফেনী: বাঁশ কাটা, যত্ন ও অবহেলার কারণে ব্যবহারিক জীবনে অতি প্রয়োজনীয় বাঁশ-ঝাড ও বেত হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় এ ফেনী জেলার বাঁশের ব্যাপক চাষ করা হত। সামান্য যতœ আর বিনা খরচে গড়ে ওঠত বাঁশের বাগান নদী আর খালের পাশে জন্ম নিতো বেত। কিন্ত আজ অযতœ আর অবহেলায় আর সরকারী উদ্যোগের অভাবে সেই বাঁশ ও বেত বাগান বিলীন হতে চলেছে। জানা যায়, এ এলাকার মানুষ এক সময় প্রসুতির কাজে সন্তানের নাড়ি কাঁটার জন্য বাঁশের চিকন চাঁচ ব্যবহার করত, আবার মৃত ব্যক্তিকে দাফনের জন্য কবরে বাঁশ বিছিয়ে দিয়ে তারপর মাটি দিত এবং বর্তমানেও দিচ্ছে। তাই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঁশের প্রয়োজন অতুলনীয়। আগে গৃহস্থদের বাঁশ বাগান ছিল অহংকারের। কোন বংশের কত বাঁশ আছে, তা দিয়েই নির্ণয় হতো সে বংশের প্রভাব। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই প্রতিপত্তির মানদন্ড বাঁশ বাগান বা বাঁশঝাড আর দেখা যায় না। খুঁজে পাওয়া সেই শীতল পরিবেশ ঘেরা সবুজের সমারোহ। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বনজ সম্পদ বাঁশ ও বেত বাগান। মাত্র কয়েক বছর আগে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করা হত। দাগনভূঞা উপজেলার সিলোনিয়াতে মিলতো বাঁশে ও বেতের হাট। এক একটি বাঁশ বিক্রি হতো ৫০ থেকে ১২০ টাকা দরে। আর এ বাঁশ দালানকোঠা নির্মাণে ক্রয় করে নিয়ে যেত ঠিকাদাররা। এখন দালান কোঠা নির্মাণে বাশের বদলে ব্যবহার হচ্ছে টিন, লোহা ও স্টিল। পূর্বে যারা বাঁশের আঁইচ দিয়ে খাঁচা, মাঁচা, কোরা, টুকরী ও গোলা বানাতো তারা এখন বেকার। গংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং প¬াস্টিক সামগ্রীর অতি ব্যবহারে উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁশ ও বেত শিল্প এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। ফলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা এক প্রকার বাধ্য হয়ে তাদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় মনোনিবেশ করছে। বাঁশ ও বেত শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার পরিবার বর্তমানে চরম দুর্দিনের মধ্যে দিন যাপন করছে। উপকূলীয় অঞ্চল সোনাগাজীর হাজার হাজার পরিবার দীর্ঘদিন যাবৎ ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে তারা নানা সমস্যায় জর্জরিত। প্রয়োজনীয় ঋণ, পুঁজি, বাঁশ ও বেতের স্বল্পতা, মজুরি কম থাকার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্প ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক বেকার জীবনযাপন করছে। এসব শ্রমিক বংশানুক্রমে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাদের নিপুণ হাতে তৈরি কুলা, চাটাই, হাঁস-মুরগির খাঁচা, সাজি, ঢাকনা, চালনি, পালা, খাঁচা, মোড়া বেতের ধামা, পাতিল, চেয়ার, টেবিল, দোলনা, খারাই, পাখা, বই রাখার র‌্যাক, ঘুনি, ডালা, ঝুড়ি প্রভৃতি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় শিল্পসামগ্রী এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বাইরে সরবরাহ করত। বর্তমানে বাঁশ ও বেত পাওয়া যায় না বললেই চলে। প্রয়োজনীয় পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে বাঁশ ও বেতের ঝাড় মরে যাচ্ছে। সরকারি বা বেসরকারিভাবে বাঁশ ও বেত গাছ রোপণ এবং এর পরিচর্যা, বংশ বৃদ্ধিরও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। কুটির শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে এবং কাগজ তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হতো বাঁশ। বাঁশ দিয়ে নদী বা খাল পাড়াপাড়ের তৈরি করা হত বাঁশের সাঁকো। বাংলার আবহমান সঙ্গীতের প্রধান মাধ্যম বাঁশিও তৈরি হতো এই একমাত্র বাঁশ দিয়ে। এদিকে জ্বালানি সঙ্কটের কারণে অপরিপক্ব বাঁশের গোড়া তুলে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে অনেকে। অনেক বাঁশঝাড় মালিক দালান কোঠা তৈরি করায় রান্নাবান্নার কাজে বাঁশ পুড়ছে। পৃষ্ঠপোষাকতা না থাকায় এবং চাহিদা কমে যাওয়ায় বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র গৃহশোভা বর্ধনে অতুলনীয়। এখানে এক সময় ওই বিশেষ ধরনের বাঁশ পাওয়া গেলেও সে বাঁশের উৎপাদন নেই বললেই চলে। একারণে অনেক অনেক শিল্পী বেকার জীবন-জাপন করছেন। বাঁশের অভাবে কুটির শিল্পের সাথে জড়িতরা পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন জীবন নির্বাহের তাগিদে। সোনাগাজী বাজারের ক্ষুদ্র কুটির শিল্প শ্রমিক আবুল হোসেন জানান, চরে ধান আছে বলে এখনও আমরা আছ্ িগোলা, মাঠির টুকরি ও খাঁচা বানাই কোনো রকম সংসার চালাই। বাঁশের দাম বেডে যাবার কারণে এখন এসব তৈরী করে পোষায় না। বিক্রিতে দামও সস্তা তাই পেশা ছেডে দিতে হবে। ফেনীর ক্ষুদ্র কুটির শিল্প বিসিক শিল্প নগরীর ম্যানেজার জানান, প্রযুক্তি আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাঁশ বেত হয়ত ফেনী জেলায় খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আর এসব ধ্বংস হবার ফলে আমরা প্রকৃতিক বিপর্যয় রুখতে পারিনা। আমরাই এ শিল্পকে বাঁচাতে হবে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়