জাহাঙ্গীর আলম বকুল : তাল আমাদের পরিচিত একটি ফল। গ্রামবাংলায় আবহমান কাল থেকে পরিচিত এই ফলটির কদর রয়েছে। এ এমন একটি ফল যাকে বিভিন্ন প্রকারণে খাওয়া যায়। তাল খুব সুস্বাদু ও পুষ্টিকর।
তালগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Borassus flabellifer । তালগাছ ৩০ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এই গাছ কমবেশি ১০০ বছর বাঁচে।
তাল শুধু ফল হিসেবে নয়, পাকা তাল খাওয়ার পর উচ্ছিষ্ট আঁটিটা রেখে দিলে কিছুদিন পর আঁটির ভেতরে যে সাদা শাঁস হয়, তা খাওয়া যায় রান্না করে তরকারি হিসেবে। সাদা শাঁস কাঁচা খেতেও ভারি মজার।
গুরুত্বের কারণেই তালগাছ স্থান পেয়েছে কবির কবিতায়, লেখকের উপন্যাসে, কথায়, উপমায়, প্রবাদ বাক্যে। তালপাতার সেপাই, এক তাল, তাল বেতাল, তিল থেকে তাল, পিঠে তাল পড়া— এমন অনেক উপমা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাংলা সাহিত্যে।
গ্রামবাংলায় পরিত্যক্ত জমিতে, বনে-বাদাড়ে আঁটি পড়ে থাকলে সেই আঁটি থেকে কোনো পরিচর্ষা ছাড়াই তালগাছ জন্মে এবং বেড়ে ওঠে। আবার বীজতলা তৈরি করেও তালগাছ জন্মানো যায়। তালগাছ বড় করে তোলার জন্য বিশেষ পরিচর্ষার প্রয়োজন হয় না। তালগাছ কিন্তু দীর্ঘজীবী। পৃথিবীর বহু দেশে তালগাছ আছে। গাছটি তার দীর্ঘজীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই ফল দেয়।
শুধু ফল নয়, তালের রস অত্যন্ত উপাদেয় এবং সুস্বাদু। এই রস কাঁচা খাওয়া যায়, আবার রস জ্বালিয়ে গুড় বা গুড়ের পাটালি তৈরি করা যায়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তালের রস উৎপাদন হয়। তালের গুড় অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু।
তালের কাঠ অত্যন্ত মজবুত। দীর্ঘমেয়াদি এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজে তালের কাঠ ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে ঘরবাড়ির ছাউনি তৈরির কাছে। কোনো ঘরের ছাউনি তালের কাঠ দিয়ে তৈরি করা হলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় সেটি পরবর্তী শতাধিক বছর কেটসই হবে।
তাল যখন কচি থাকে, কালো-সবুজের মিশ্রণে একটা রং ধারণ করে। কাঁচা ফল হিসেবে খাওয়ার জন্য কচি তালই উপযুক্ত। বছরে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের গরমে কচি তাল পাওয়া যায়। তখন বাজারে বেশ দামে পানি-তাল বিক্রি হয়। একটি গাছে ৬০০-৭০০ পর্যন্ত তাল ধরে। কৃষক তাল বিক্রি করে বেশ দাম পায়। আবার বছরের এ সময়টা তালের ব্যবসা করেও ভালো আয় করে। দেশের অধিকাংশ ফলে ব্যবসায়ীরা ফরমালিন ব্যবহার করে থাকে- কিন্তু তালে ফরমালিন ব্যবহারের দরকার পড়ে না। সুতরাং আপনি নির্দ্বিধায় তাল খেতে পারেন।
তালগাছ অন্যান্য গাছ থেকে লম্বা হয়। ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে’। এই উঁচু গাছে নিরাপদে আশ্রয় খুঁজে নেয় বাবুই পাখিরা। বাবুই অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে খড় দিয়ে বাসা বোনে। শক্ত বুননের এ বাসাটি শিল্পের এক ঐশ্বর্য, যা প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও ঝুলতে থাকে তালের পাতার সঙ্গে। বাবুই ছাড়াও অঞ্জন, বাদুড়সহ নানা প্রাণী আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয় তালগাছকে।
‘তালের পাখার এমনই গুণ, বাতাস খেলে আসবে ঘুম’- ছড়ার এই বাক্যটির মাধ্যমে বোঝা যায় গ্রামবাংলায় তালের পাখা কতটা প্রিয়। ছোট তালগাছের পাতা থেকে তৈরি হয় হাতপাখা। গরমে গ্রামবাংলায় সাধারণ মানুষের শীতল বাতাস দেয় এই পাখা। সারা দেশের কারিগররা এই পাখা তৈরি করে। তবে কুষ্টিয়ার কয়েকটি গ্রামের শতাধিক পরিবার তালের হাতপাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে।
তালের পাতা শুধু পাখা নয়, ঘরের ছাউনি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। গ্রামের দরিদ্র মানুষ তার কুঁড়ে ঘরের ছাউনি হিসেবে তালগাছের পাতা ব্যবহার করে। তালের পাতার ছাউনির ঘর গরমের দিনে টালির ঘরের থেকে আরামদায়ক।
তাল যখন পাকে, ঘন কালো রং ধারণ করে; স্বাদও পাল্টে যায় সম্পূর্ণ। পাকা তাল খাওয়া যায়, আবার সেটি রান্না করেও খাওয়া যায়। তালের নির্যাস জ্বাল দিয়ে ঘন করে খেতে হয় ভাতের সঙ্গে।
তালগাছের সবটুকুই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তালের পাতা প্রতিদিনের ঘরগৃহস্থ জ্বালানি। তালগাছও জ্বালানির জন্য ভালো। আবার গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি হয় ঢেঁকির নোট। ঢেঁকি গ্রামবাংলায় বহুল প্রচলিত। তালগাছ মানুষকে রক্ষা করে ঝড়ঝঞ্ঝাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে।
গ্রামবাংলায় তালের গাছ দিয়ে তৈরি হয় ডোঙ্গা। একসময় তালের এই বিশেষ নৌকা ছিল গ্রামের লোকজনের যাতায়াতের অন্যতম বাহন। দু-তিনজনের পারাপার, মাছ ধরা, ধান কাটা, শাপলা তোলা, শামুক সংগ্রহ, বিল বাঁওড় পুকুরে মাছের ঘেরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো তালের ডোঙ্গা। তালের ডোঙ্গার বাইচও ছিল গ্রামবাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা। ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সী একটি তালগাছ থেকে দুটি ডোঙ্গা তৈরি করা যায়। ভালো গাছের ডোঙ্গা ৮-১০ বছর ব্যবহার করা যায়।
বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যতে রয়েছে পিঠাপুলি। শীতে গ্রামাঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে পিঠা তৈরির ঘুম পড়ে যায়। অতিথি আপ্যায়নে পিঠা অতি জনপ্রিয়। এই পিঠা যদি তৈরি হয় তালের রস বা গুড় থেকে তাহলে তার কদর বেড়ে যায় বহুগুণ। শুধু তালের গুড় নয়, পাকা তালের নির্যাস থেকে হরেক রকমের পিঠা তৈরি করা যায়। স্বাদের দিক থেকে এ পিঠার তুলনা নেই।
তালের পুষ্টিগুণের উপস্থিতিতে আছে ব্যাপক বৈচিত্র্য। তালে থাকে প্রচুর পরিমাণ খনিজ ও আঁশ। প্রোটিন, শর্করা, চর্বি, অ্যামাইনো অ্যাসিডেরও ভালো উৎস তাল। এ ছাড়া আছে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক ও আয়রন।
তাল অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণসমৃদ্ধ হওয়ায় ক্যানসার প্রতিরোধে সক্ষম। এ ছাড়া হৃদ্রোগের সুরক্ষায়ও তাল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
খবর বিভাগঃ
ফিচার
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়